বরিশাল ও রাজশাহীতে নৌকার বিজয়, সিলেটে ফল স্থগিত

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.07.30
ঢাকা
180730_City_Election_1000.jpg রাজশাহীতে বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসনে বুলবুল নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে হতাশায় ইসলামিয়া কলেজ কেন্দ্রের মাঠে বসে থাকেন। তিনি নিজের ভোটটিও দেননি। ৩০ জুলাই ২০১৮।
বেনারনিউজ

ভোট বর্জন ও ‘জালিয়াতির’ অভিযোগের মধ্যে খুলনা ও গাজীপুর সিটির পর আরও দুটি সিটি করপোরেশনে (বরিশাল ও রাজশাহী) জয়ী হয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। সিলেট সিটিতে বিএনপি প্রার্থী ভোটে এগিয়ে থাকলেও আইনগত কারণে ফল স্থগিত রাখা হয়েছে।

সোমবার একযোগে অনুষ্ঠিত রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এসব নির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বরিশালে সকল বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের অনিয়মের অভিযোগের মধ্যে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয়।

রাজশাহী সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন পেয়েছেন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩৯৪ ভোট। অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থী বুলবুল পেয়েছেন ৭৮ হাজার ৪৯২ ভোট। রাজশাহীতে মোট ভোটকেন্দ্র ১৩৮টি। অনানুষ্ঠানিকভাবে ১৩৮টি কেন্দ্রের ফলাফলই পাওয়া গেছে।

আর বরিশাল সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ প্রায় এক লাখ ভোটে এগিয়ে আছেন এবং ভোটের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তাঁর বিজয় নিশ্চিত।

সিলেটে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী ৪৬২৬ ভোটে ভোটে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের চেয়ে এগিয়ে আছেন। ১৩৪টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৩২টি কেন্দ্রর ফল প্রকাশ হয়েছে, স্থগিত আছে দুটি কেন্দ্রের ফল। স্থগিত এই দুটি কেন্দ্রের ভোট সংখ্যা ৪৭৮৭। তাই বিএনপি প্রার্থী এগিয়ে থাকলেও ফল ঘোষণা করা হয়নি। নির্বাচন কমিশন পরবর্তীতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে।

গত ১৫ মে খুলনা সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তালুকদার আব্দুল খালেক ও ২৭ জুন গাজীপুর জাহাঙ্গীর আলম বিএনপি প্রার্থীকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। ওই সিটি নির্বাচনেও ভোটে অনিয়মের অভিযোগ তোলেন বিএনপি দলীয় প্রার্থীরা।

আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের একটি ট্রায়াল বলে উল্লেখ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ।

ঢাকায় বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ সাংবাদিক সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, “আমরা সরকারের যে ‘নীল নকশার’ নির্বাচনের কথা বলছিলাম তিন সিটি নির্বাচন সেই ‘নীল নকশার’ বহিঃপ্রকাশ।”

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার তার দলের ‘জয় জোর করে ছিনিয়ে’ নিচ্ছে।

তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করতেই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ করছে।

সোমবার রাজশাহী, সিলেট ও বরিশালে সকাল আটটায় একযোগে ভোট শুরু হয়। চলে একটানা বিকেল চারটা পর্যন্ত। বৃষ্টির কারণে দুপুরে কিছুটা ভোট দেয়ার গতি কমে গেলেও শেষ এক ঘণ্টায় ভোট দেয়ার গতি বেড়ে যায়।

রাজশাহী ও সিলেটে বিএনপি প্রার্থীরা বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র ঘুরে দেখেন।

রাজশাহীতে বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসনে বুলবুল বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখেন। একটি কেন্দ্রে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে গেছে এমন সংবাদের পর তিনি সেখানেই বসে থাকেন। তিনি নিজের ভোটটি দেননি।

তবে খায়রুজ্জামান লিটন সাংবাদিকদের বলেন, “নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগ একবারেই ভিত্তিহীন।”

সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরী বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেন, “এই নির্বাচনের মতো এত বড় জালিয়াতির নির্বাচন আমার জীবনে দেখিনি। এটা ভোট নামে প্রহসন।”

তিনি বলেন, “এই নির্বাচন কমিশনের কোনো মেরুদণ্ড নেই। আমরা অভিযোগ নিয়ে গেলাম কিন্তু তারা কোন ব্যবস্থা নিলেন না।”

বদরুদ্দীন আহমেদ কামরান সিলেটে সাংবাদিকদের বলেন, “বিরোধী দলের প্রার্থীরা আগে থেকেই অনিয়মের অভিযোগ তোলেন। যদি তারা হেরে যান তাহলে বলেন, ‘আমরা তো আগেই বলেছি, ভোট জালিয়াতি হয়েছে’। আর যদি জয়ী হয়ে যান তখন বলেন, ‘কারচুপি না হলে আমরা আরও বেশি ভোটে নির্বাচিত হতাম’।”

সকাল আটটায় ভোটাভুটি শুরুর চার ঘণ্টার মাথায় সাংবাদিক সম্মেলন করে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন বরিশালে বিএনপি’র প্রার্থী মজিবর রহমান সরওয়ার। ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ এনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন তিনি।

বরিশালের পীর চরমোনাইয়ের দল ইসলামি আন্দোলনের প্রার্থী ওবায়দুর রহমানও ভোট বর্জন করেছে।

রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পৃথকভাবে অনিয়ম ও জালিয়াতির লিখিত অভিযোগ উত্থাপন করে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট গ্রহণ স্থগিত করার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী মো ইকবাল হোসেন ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল মনোনীত প্রার্থী মনীষা চক্রবর্তী।

তবে রিটার্নিং কর্মকর্তা মজিবুর রহমান অভিযোগ পেয়েছেন বলে সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করলেও ভোট স্থগিত করেননি।

তিনি দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, “অনিয়মের যেসব অভিযোগ পেয়েছি সেগুলো পর্যালোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।”

বেলা ১২টার দিকে বিএনপি প্রার্থী মজিবুর রহমান সারোয়ার বরিশাল প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, “আজ প্রশাসনের সামনে যে ঘটনা ঘটল, যে ঘটনা বরিশালবাসী প্রত্যক্ষ করল সেব্যাপারে আমরা চুপ থাকতে পারি না। এর প্রতিবাদে আমরা নির্বাচন থেকে সরে যাচ্ছি। নির্বাচন বর্জন করছি।"

তিনি বলেন, মোট ১২৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ৭০-৮০টি কেন্দ্রে তার পোলিং এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বাকি যেসব কেন্দ্রে তার এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হয়েছে তারা ‘নৌকা মার্কায় সিল মারতে দেখেছেন’।

সরোয়ার অভিযোগ করে বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। এভাবে চলতে পারে না। নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছি যেন এই নির্বাচন স্থগিত করে। কিন্তু তারা আমাদের কথায় গুরুত্ব দেয়নি।

তিনি বলেন, “তাই নির্বাচন কমিশনের প্রতি নিন্দা। এই নির্বাচন আমরা প্রত্যাখ্যান ও বর্জন করলাম।”

আওয়ামী লীগ ও ইসি সন্তুষ্ট

আওয়ামী লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, কাউন্সিলদের মধ্যে দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া তিন সিটি করপোরেশনের কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। নির্বাচন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, “বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশ নিতে চায় নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করতে। আজ ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয় যে তারা নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করতেই সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। বরিশালে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে নির্বাচন বর্জন করতে হবে।”

তিন সিটি করপোরেশনের ভোট নিয়ে সন্তুষ্ট নির্বাচন কমিশন। সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেন, “সব মিলিয়ে নির্বাচন ভালো হয়েছে। আমরা সন্তুষ্ট।”

কিছু অনিয়ম ছাড়া বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে জানিয়ে সিইসি বলেন, ‘যেখানে সমস্যা হয়েছে সেখানে তো আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। যেসব কেন্দ্রের বিষয়ে অভিযোগ এসেছে, তা তদন্ত হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পলিটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান বেনারকে বলেন, “জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচন নির্বাচনগুলো নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি পরীক্ষা বলা যায়।

তিনি বলেন, নির্বাচন পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি ছিল বিএনপি’র। আর আওয়ামী লীগ এর বিরুদ্ধে। সুতরাং, বিভিন্ন অনিয়ম থাকলে সেগুলো জনগণের কাছে তুলে ধরতে চাইবে বিএনপি।

তাঁর মতে, বিরোধী দল প্রমাণ করতে চাইবে এই সরকারের ও নির্বাচন কমিশনের আওতায় সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। এর মাধ্যমে তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।