গায়েবি মামলায় বিএনপির কয়েকশ নেতাকর্মী আসামি

প্রাপ্তি রহমান
2018.10.02
ঢাকা
181002_Fictitious_cases_1000.jpg গ্রেপ্তারের পর বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে হাজির করে পুলিশ। ২ অক্টোবর ২০১৮।
বেনারনিউজ

পুলিশের দেওয়া ২২ দফা শর্ত মেনে রাজধানীতে সমাবেশ করার ঠিক পরদিনই সারাদেশে বিএনপির কয়েকশ নেতাকর্মীকে ১৯৩টি মামলায় আসামি করা হয়েছে। পুলিশের দায়ের করা নতুন ও পুরনো এসব মামলায় জড়ানো হয়েছে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদেরও।

“ঘটনাই ঘটেনি, তারপরও মামলা দেওয়া হচ্ছে,” জানিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা এগুলোকে ‘গায়েবি মামলা’ বলছেন।

তবে তাঁদের অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক সোহেল রানা বেনারকে বলেন, “সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতেই পুলিশ মামলা দায়ের করে।”

অভিযোগ রয়েছে, গত ২৯ জুলাই দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার জেরে সড়ক পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালে গায়েবি মামলার সংস্কৃতি শুরু হয়। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিচারে ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার পুরানো কেন্দ্রীয় কারাগারে আদালত বসানোর পর তা আরো বেড়ে যায়।

মঙ্গলবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা, টাঙ্গাইল, নোয়াখালী, ভোলা, ঝিনাইদহ, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা দক্ষিণ, নরসিংদীতে গায়েবি মামলায় শতাধিক নেতাকর্মীর গ্রেপ্তারের তথ্য প্রকাশ করে বিএনপি।

বিএনপির রবিবারের সমাবেশের আগে-পরে ৩৭টি মামলায় পুলিশ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মোট ১৯৩ জনকে গ্রেপ্তার করে উপস্থাপন করে। এর মধ্যে নাশকতা ও পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে ১৭৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন মঞ্জুর করে আদালত।

জাতীয় নির্বাচনের আগে পুলিশের এই ভূমিকা ভোটের মাঠেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, “ঘটনা না ঘটলেও যেভাবে মামলা দায়ের করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে এটা একটা পরিকল্পনার অংশ।”

“এ অবস্থা চলতে থাকলে সংসদ নির্বাচনে সবার জন্য যে সমান সুযোগ তৈরি হওয়া প্রয়োজন, তা হবে না। যে কারণে এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়নি,” বলেন তিনি।

নাশকতায় অভিযুক্ত জ্যেষ্ঠ নেতারা

রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় পুলিশের কাজে বাধা ও নাশকতার মামলায় আসামি হয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ৫৫ জন প্রভাবশালী নেতা।

এর মধ্যে রয়েছেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমান উল্লাহ আমান, রুহুল কবির রিজভী ও সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার প্রমুখ।

হাতিরঝিল থানার উপপরিদর্শক মো. শরিফুল ইসলাম বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। তাঁর অভিযোগ, ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপি নেতারা সমাবেশে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। এছাড়া সমাবেশ শেষে সন্ধ্যায় বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং জামাত ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের নিয়ে পুলিশের সরকারি দায়িত্ব পালনে বাধা, আক্রমণ ও ‘হত্যার উদ্দেশ্যে’ জখম করেন।

পুলিশের অনুরোধ উপেক্ষা করে রাস্তায় যান চলাচলে বাধা দেওয়া, দুটি সিএনজি ও একটি বাস ভাংচুর এবং ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টিরও অভিযোগ করা হয়।

এজাহারে ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি বাঁশের লাঠি, দেড় লিটার পেট্রল, লাল স্কচটেপে মোড়ানো বিস্ফোরিত ককটেলের অংশ বিশেষ, কিছু ভাঙা কাচ ও ইটের টুকরা উদ্ধারের উল্লেখ আছে।

হাতিরঝিলের বিভিন্ন পয়েন্টে নিয়মিত আসেন, এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে মঙ্গলবার কথা হয় বেনার প্রতিনিধির। তারা কেউ ৩০ সেপ্টেম্বরে ওই এলাকায় গাড়ি ভাংচুর বা ককটেল বিস্ফোরণের কোনও ঘটনা দেখেনি।

ওই এলাকায় বছর পাঁচেক ধরে বাদাম বিক্রি করেন মফিজউদ্দীন। তিনি বেনারকে বলেন, “অত্র এলাকায় ৩০ তারিখ ক্যান, গত ৩০ দিনেও কোনো ভাংচুর বা ককটেল ফোটার ঘটনা ঘটে নাই।”

“আমি তো রোজই দুপুর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এনোই (এখানেই) থাকি,” বলেন মফিজউদ্দীন।

বিএনপির মৃত নেতাও আসামি

পুলিশের গায়েবী মামলায় বিএনপির মৃত নেতাকর্মীকেও আসামি করার নজির আছে।

রাজধানীর চকবাজার থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় চকবাজার থানা বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুল আজিজ উল্লাহ, নাজিমউদ্দীন ও চান মিয়াকে আসামি করা হয়। আজিজ উল্লাহ ২০১৬ সালের মে মাসে মারা যান আর ঘটনার দিন চান মিয়া হজ পালনের জন্য সৌদি আরবে ছিলেন।

এখানেই শেষ নয়, ছেলের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল হকের বিরুদ্ধেও গাড়ি ভাংচুরের মামলা হয় গাজীপুরে।

মঙ্গলবারে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির বিশাল জনসমাবেশের পর থেকে সরকার ক্ষিপ্ত ও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছে।”

“জনসভা শেষে পাইকারী হারে বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরপর বিএনপি’র জ্যেষ্ঠ নেতাদের তালিকা ধরে তাঁদের বিরুদ্ধে হাস্যকর মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।”

সংবাদ সম্মেলনে রিজভী অভিযোগ করেন, তাঁর দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশের কাছে আগে থেকেই মামলা সাজানো থাকে।

“পুলিশের কাছে আষাঢ়ে গল্পের একটা ফরম্যাট সবসময় প্রস্তুত করা থাকে। সময় মতো বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে সেগুলো ব্যবহার করা হয়। এবারেও পুলিশ তাই করেছে,” বলেন তিনি।

গায়েবি হিসাবে চিহ্নিত ওই ১৯৩ মামলার ব্যাপারে পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানা অভিমত, “আমাদের মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে যদি কোনো ভুল ভ্রান্তি থেকে থাকে, তাহলে সেগুলো আদালতে বিচার্য।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।