হাতির আক্রমণে ১১ মাসে ১২ রোহিঙ্গার মৃত্যু

জেসমিন পাপড়ি ও আবদুর রহমান
2018.07.19
ঢাকা ও কক্সবাজার
হাতির আক্রমণে ১১ মাসে ১২ রোহিঙ্গার মৃত্যু-1 কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে প্রচারনা চালাচ্ছে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের প্রধান মো. সাদেক। ১৬ জুলাই ২০১৮।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত গত ১১ মাসে হাতির আক্রমণে শিশুসহ ১২ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। প্রাণে বাঁচতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় মিললেও বন্য হাতির আক্রমণের ভয়ে দিন কাটাচ্ছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা।

রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের উখিয়ায় যেখানে বন কেটে বসতি নির্মাণ করেছে, সেখানে একসময় হাতির বিচরণক্ষেত্র ছিল। পুরোনো সে পথ ধরে চলতে গিয়ে প্রায়শই বন্য হাতি রোহিঙ্গা শিবিরে ঢুকে পড়ে।

তবে সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বন্য হাতির দ্বন্দ্ব কমাতে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সহায়তায় এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে। এর লক্ষ্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রোহিঙ্গা, আশপাশের বন এবং হাতি রক্ষা তাদের উদ্দেশ্য।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা শিবিরে বন্য হাতির আক্রমণে ইতিমধ্যে তিনজন শিশুসহ প্রায় ১২ জন রোহিঙ্গার প্রাণহানি হয়েছে। তবে শিবিরে হাতির আক্রমণ কমাতে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম কাজ করছে। এটা শুধু হাতি সংরক্ষণই নয়, রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।”

তিন মাস আগে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম গঠিত হয়। ইউএনএইচসিআর এর এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন)।

বাংলাদেশ বন বিভাগ এবং শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি), স্থানীয় জনগণ ও আশ্রিত রোহিঙ্গারা এতে সহযোগিতা বলে বেনারকে জানান আইইউসিএন’র কক্সবাজারের প্রধান রাকিবুল আমিন।

তিনি বেনারকে বলেন, “বর্তমানে যেখানে বন কেটে রোহিঙ্গা বসতি নির্মাণ করা হয়েছে সেটি হাতির বিচরণ ক্ষেত্র ছিল। বন্য হাতি এখনো সেখানে চলে এসে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা করায় বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাই মৃত্যু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আশ্রিত রোহিঙ্গা ও বন্য হাতি উভয়কেই বাঁচিয়ে রাখতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।”

রোহিঙ্গা ও বন্য হাতি উভয়কে রক্ষায় গঠিত এই টাস্কফোর্স ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে কাজ করছে বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম।

প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনা নির্যাতনের ফলে গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন। পুরোনোসহ উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পাহাড় ও বন কেটে সেখানে অবস্থান করছেন।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের কর্মকর্তা আলী কবির বলেন, “ইতিমধ্যে ছয় হাজার একর পাহাড় ও বন কেটে রোহিঙ্গাদের বসতি গড়ে উঠেছে। ফলে বন্য প্রাণী চলাচলে জায়গা কমে গেছে। এ জন্য রোহিঙ্গা শিবিরে বারবার আক্রমণ চালায় হাতি।”

“যেসব বন কাটা হয়েছে সেখানে কিছু গাছ রোপণ করা হচ্ছে। কেননা বন বাঁচতে বন্য প্রাণী বাঁচবে, তা ছাড়া বন থাকলে হাতি আর শিবিরে প্রবেশ করবে না,” বলেন তিনি।

রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় ৪০টি হাতি সক্রিয় রয়েছে বলে ধারণা করছে বন বিভাগ। তারা বলছে, রোহিঙ্গারা বন কেটে বসতি ও জ্বালানিতে ব্যবহার করায় হাতিদের চলাফেরার রাস্তা ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। স্বভাবগতভাবে নিজেদের চলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে হাতি তা ভেঙে ফেলার চেষ্টা চালায়।

 

এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম

কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় ছয়টি রোহিঙ্গা শিবিরে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে। এগুলো হলো মধুরছড়া, বালু খালি, জামতলি, শীলখালী, ঠ্যাংখালী ও সবুল্ল্যাখালী রোহিঙ্গা শিবির।

এসব শিবিরগুলোতে ৩৬০জন কর্মী কাজ করছে, যাদের সবাই রোহিঙ্গা।

এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের কর্মকর্তা ও আইইউসিএন কক্সবাজারের সহকারী মোহম্মদ সুলতান বেনারকে বলেন, “কীভাবে হাতি তাড়ানো হয় সে বিষয়ে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের সদস্যদের প্রশিক্ষিত করা হয়। একসঙ্গে ৩০জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।”

“এর ফলে শিবিরে বন্য প্রাণী ঠেকাতে অগ্রগতি দেখা দিয়েছে। আগে শরণার্থীশিবিরে হাতি ঢুকলে রোহিঙ্গারা আক্রমণের শিকার হতো। রোহিঙ্গা ও হাতের মধ্যকার দ্বন্দ্ব অনেকটাই কমে এসেছে,” বলেন তিনি।

উখিয়া মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবিরের এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের (ইআরটি) প্রধান মোহাম্মদ সাদেক বেনারকে বলেন, “আগের তুলনায় বর্তমানে হাতির সঙ্গে মুখোমুখি হতে এখন ভয় কম। কেননা কীভাবে হাতির সঙ্গে মুখোমুখি করতে হবে সেই প্রশিক্ষণ আইইউসিএন ইতি মধ্যে আমাদের দিয়েছে।”

হাতি তাড়ানোর উপায় ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “সাধারণত হাতিরা রাতে রোহিঙ্গা শিবিরে প্রবেশ করে। তবে এখন শিবিরে হাতি ঢুকলে প্রথমে একটি পথ খোলা তিন দিকে ঘিরে রাখা হয়। এরপর টর্চ লাইট ও মাইক দিয়ে হাতি তাড়ানো হয়। আবার মাঝে মধ্যে আগুনেরও সহযোগিতা নেওয়া হয়।”

“তবে সামনে আরও বেশি বন্য প্রাণীর চলাফেরা বাড়তে পারে বলে আমার সতর্ক অবস্থানে রয়েছি,” বলেন মোহাম্মদ সাদেক।

উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবিরে ১০ মাস ধরে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন বিবি আয়েশা নামে এক রোহিঙ্গা নারী।

তিনি বেনারকে বলেন, “মৃত্যুর ভয়ে রাখাইন রাজ্যে ছেড়ে এপারে পালিয়ে এসেছি। কিন্তু এখানেও মাঝে মধ্যে বন্য প্রাণীর ভয় কাজ করছে। তবে সেই ভয় আগের চেয়ে কমেছে, কেননা বর্তমানে বন্য প্রাণী নিয়ে একটি সংস্থা আমাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।”

 

‘ওয়াচ টাওয়ার’

বন্য প্রাণীর পাহারায় কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে ইতিমধ্যে ৫১টি ‘ওয়াচ টাওয়ার’ নির্মাণ করা হয়েছে। আরও ৯টি ‘ওয়াচ টাওয়ার’ নির্মাণের কাজ চলছে। প্রতি টাওয়ারে দুজন করে দায়িত্ব পালন করে। তারা সন্ধ্যায় ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত সেখানে পাহারা দিয়ে থাকে।

ওয়াচ টাওয়ারের কর্মী আশরাফুজ্জামান বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গা ও হাতি উভয়কে কীভাবে নিরাপদ রাখা যায়, সেই কথায় মাথায় কাজ করে যাচ্ছি। টাওয়ার থেকে রোহিঙ্গা শিবিরে কোনো হাতি প্রবেশ করলে সঙ্গে সঙ্গে মাইক নিয়ে সবাইকে সতর্ক করা হয়।”

“যদি হাতি শিবিরে ঢুকে পড়লে, ওই এলাকায় রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়া হয়। তারপর এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের সকল কর্মীরা মিলে হাতি তাড়ানো হয়। পাশাপাশি ঝুঁকির বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণাও চালানো হচ্ছে শিবিরে। তবে তার বিনিময়ে আমার যে অর্থ পেয়ে থাকি তা খুবই কম,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।