জলবায়ু পরিবর্তন: আন্তর্জাতিক পূর্বাভাসের সময়সীমার আগেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাস্তচ্যুতি শুরু

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.05.07
ঢাকা
জলবায়ু পরিবর্তন: আন্তর্জাতিক পূর্বাভাসের সময়সীমার আগেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাস্তচ্যুতি শুরু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে নদীভাঙন ও বন্যায় প্রায় ডুবন্ত মেঘনার মোহনায় ভোলার মনপুরা দ্বীপে খেয়া নৌকার জন্য অপেক্ষা করছেন স্থানীয়রা। ২২ আগস্ট ২০২১।
[বেনারনিউজ]

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় লবণাক্ততা, ভূমি ডুবে যাওয়াসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানুষ বাস্তচ্যুত হতে শুরু করেছে। 

উপকূলীয় বৃহত্তর খুলনা ও বৃহত্তর বরিশাল এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ দেশের বিভিন্ন শহরে, মূলত বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছে, যদিও সরকারি–বেসরকারি কোনো উদ্যোগে এই সংখ্যাটি খুঁজে দেখা হয়নি। 

গত এপ্রিলে ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্টিফিক গ্রুপ আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে কমপক্ষে ১৩ লাখ মানুষ বাস্তচ্যুত হবে। এই মানুষগুলো প্রথমে ঢাকা শহরে এবং পরে দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়বে। 

তবে বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলো থেকে বাস্তচ্যুত হয়ে মানুষ শহরে পাড়ি জমাতে শুরু করেছে।

খুলনা বিভাগীয় বেসরকারি সংস্থা উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোটের প্রধান মেহেদি হাসান বেনারকে বলেন, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর তাঁর প্রতিষ্ঠান একটি গবেষণা পরিচালনা করে।

“গবেষণা অনুযায়ী, সাতক্ষীরা সদর, শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালীগঞ্জ, খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও শরণখোলা, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ ও রামপালের কিছু অংশ, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া, বরগুনা জেলার সদর উপজেলা, তালতলি ও আমতলি উপজেলা থেকে এক লাখ ২৪ হাজার মানুষ এক বছরের জন্য এবং ১৫ হাজার ছয়’শ মানুষ স্থায়ীভাবে খুলনা, সাতক্ষীরা শহর, যশোর, চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় আশ্রয় নিয়েছেন,” জানান তিনি।

মেহেদি হাসান বলেন, “এই মানুষগুলোর বসতভিটা ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রধান কারণ, এখানে চাষযোগ্য কোনো জমি নেই, কাজ নেই। লোনাপানি পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে শুধু চিংড়ি চাষ হয়। চিংড়ি চাষে তেমন শ্রমিক প্রয়োজন হয় না।” 

তিনি বলেন, “শুধু জীবিকা নির্বাহের বিষয় নয়। লবণাক্ত পানির কারণে সেখানে স্বাদু পানির অভাব রয়েছে। স্বাদু পানি ছাড়া মানুষের জীবন পরিচালনা করা সম্ভব নয়।” 

মেহেদি হাসান বলেন, “প্রতিনিয়ত এই অঞ্চলের মানুষ প্রতিকুল পরিবেশের অভিঘাতের কারণে উপকূলীয় গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক পূর্বাভাসের চেয়ে অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল থেকে বাস্তচ্যুতি ঘটছে। মানুষ পরিবেশ উদ্বাস্তু হচ্ছে।” 

তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।” 

উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, ২০২০ সালের আম্ফান ঝড়ের পর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস থেকে কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি ও দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন দুটি পানিতে তলিয়ে গেছে। সেখানকার কয়েক হাজার মানুষ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে।

সব মিলে হুমকিতে থাকা উপকূলীয় অঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার বলে জানান মেহেদি হাসান।  

‘ঢাকার বস্তিগুলোর ৭০ ভাগ মানুষ প্রাকৃতিক অভিঘাতের শিকার’

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর চার লাখ মানুষ ঢাকায় চলে আসেন।

ইন্টারন্যাশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের হিসাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গত এক দশকে সাত লাখ মানুষ বাস্তচ্যুত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) হিসাবে, ঢাকা শহরের বস্তিগুলোতে বসবাস করা মানুষের শতকরা ৭০ ভাগ বিভিন্ন প্রাকৃতিক অভিঘাতের শিকার।

ঢাকার পল্লবী এলাকায় গত তিন দশকে গড়ে উঠেছে, ভোলা বস্তি। সেখানে ভোলা সদরের ইলিশ্যা এলাকা থেকে আসা কমপক্ষে ১০ হাজার বাস্তচ্যুত মানুষ বসবাস করেন।

মেঘনা নদীর ভাঙনের ফলে ঢাকার ভোলা বস্তিতে বসবাসকারী মো. মিজান বেনারকে বলেন, “ইলিশ্যার হাজার হাজার মানুষ ভোলা বস্তিতে বসবাস করেন। আমরা সবাই নদী ভাঙনের শিকার। নদী আমাদের বাড়িঘর নিয়ে গেছে। কী করব। তাই এখন এখানেই থাকি।” 

বর্তমানে মাছ বিক্রেতা মিজান বলেন, “এখনও প্রতিদিন মানুষ ভোলা বস্তিতে আসছেন। নদী ভাঙন বন্ধ না হলে মানুষ আসবেই।” 

CL_02.JPG
ঢাকার দোহারে বন্যাকবলিত একটি রাস্তায় পানি ভেঙে হাঁটছেন স্থানীয়রা। ২৬ জুলাই ২০২০। [বেনারনিউজ]

উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের শিকার বাংলাদেশ

বাংলাদেশের হয়ে ২০০৬ সাল থেকে জাতিসংঘের প্রতিটি জলবায়ু বিষয়ক আলোচনায় অংশ নেয়া কর্মকর্তা ও পরিবেশ অধিদপ্তরের জলবায়ু বিষয়ক বিকল্প ফোকাল পয়েন্ট জিয়াউল হক বেনারকে বলেন, ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ছোট ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে মানুষের বাস্তচ্যুত হওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। 

তিনি বলেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, “বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৪৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার শতকরা ১১ ভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে। এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯ জেলায় বসবাসকারী তিন কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৭০ লাখ থেকে এক কোটি মানুষ বাস্তচ্যুত হবে।” 

জিয়াউল হক বলেন, “উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের কারণে বাংলাদেশ এই বিপদের শিকার। উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ যত তাড়াতাড়ি কমানো যাবে আমরা ততো তাড়াতাড়ি ক্ষতির হাত থেকে বাঁচব; আমাদের ভূমি সাগরে তলিয়ে যাওয়া বন্ধ হবে।” 

তিনি বলেন, “সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রথম শিকার হবে আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো, সেখানে ইতিমধ্যে বাস্তচ্যুতির ঘটনা ঘটছে।”

জিয়াউল হক বলেন, “বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আলোচনায় বারবার যে কথা বলে আসছে সেটি হলো, আপনারা কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করুন। আর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের দায়িত্ব নিতে হবে।” 

বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের প্রধান হাফিজ খান বেনারকে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাস্তচ্যুতি এবং মানুষের অভিবাসন বিষয়ে উন্নত ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এখনও একমত হতে পারেনি।” 

তিনি বলেন, “বাস্তচ্যুতি ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের বিষয়টি জানতে প্যারিস চুক্তির আওতায় লস অ্যান্ড ড্যামেজ সংক্রান্ত নির্বাহী কমিটি ২০১৫ সালে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। সেই টাস্কফোর্স ২০১৮ সালে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।”

“তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে যে বাস্তচ্যুতি ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ঘটবে তা নিয়ে আমাদের আরও সোচ্চার হতে হবে। উন্নত বিশ্বকে মানুষের দায়িত্ব নিতে হবে,” বলেন তিনি। 

লস অ্যান্ড ড্যামেজ কমিটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব নুরুল কাদির বেনারকে বলেন, “আমাদের দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে খুব বেশি উচ্চতায় অবস্থিত নয়। সেকারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে আমাদের দেশের উপকূলীয় অনেক নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে যাবে।” 

তিনি বলেন, “সেখানকার মানুষগুলো শহরাঞ্চলে চলে আসবে। বিভিন্ন শহরের মূলত বিভিন্ন বস্তিতে তাদের আশ্রয় হবে। এই বাস্তচ্যুতি আমাদের জন্য বিরাট একটি চ্যালেঞ্জ।” 

নুরুল কাদির বলেন, “বাংলাদেশ বরাবর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাস্তচ্যুতি এবং অভ্যন্তরীণ অভিবাসন নিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে কথা বলে আসছে। আর এর ফলে ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে অভিবাসন বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এটি বাংলাদেশের অর্জন।” 

তিনি বলেন, “আগামী দিনে এই জলবায়ু উদ্ধাস্তুদের উন্নত দেশগুলোতে অভিবাসনের দাবি শক্তিশালী হবে।”

পরিবেশবিদ ও গবেষক ড. আইনুন নিশাত বেনারকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে, লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তচ্যুত হবে। 

“ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্র যেমন কিরিবাতি, সলোমন আইল্যান্ড হয়তো পুরোপুরি ডুবে যাবে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “উন্নত বিশ্বের দেশ যেমন সুইডেন ও অস্ট্রেলিয়া এই সকল ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর সকল নাগরিকদের গ্রহণ করবে। কারণ এই সকল দেশগুলোর জনসংখ্যা খুবই কম।” 

“কিন্তু সমস্যা হবে বাংলাদেশসহ বহুল জনসংখ্যার দেশগুলোকে নিয়ে। এত সংখ্যক মানুষকে নিতে চাইবে না উন্নত দেশগুলো,” বলেন ড. আইনুন নিশাত।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।