বিলুপ্তির হুমকিতে দেশের ছয় শ’ প্রজাতির পাখি

শরীফ খিয়াম
2019.05.10
ঢাকা
190510_Migratory_Birds_Day_1000.jpg দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফলাহারী পাখি বড় বসন্ত বাউরি বা ধনিয়া পাখির এই ছবিটি বরিশাল মহানগরীর কলেজ পাড়া এলাকা থেকে তোলা। ২৭ অক্টোবর ২০১২।
[শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ]

বাংলাদেশের সাতশ’ প্রজাতির পাখির মধ্যে কমপক্ষে ছয়শ' প্রজাতির ভবিষ্যত হুমকির মুখে। স্রেফ প্রজননের জায়গার অভাবেও অনেক প্রজাতির বংশ বিস্তার হচ্ছে না।

শুক্রবার বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবসে বেনারকে দেওয়া সাক্ষাতকারে এ তথ্য দিয়েছেন পাখি বিশারদ ইনাম আল হক। তিনি জানান, পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে বিপন্ন বন্য ও পরিযায়ী পাখিরা।

“বাংলাদেশের সাতশ' প্রজাতির পাখির মধ্যে বড়জোর একশ' প্রজাতির পাখি মানুষকে ভয় পায় না,” জানিয়ে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম বলেন, “বর্জ্যভুক পাখিগুলো ভালোই আছে, তাদের সংখ্যাও বেড়েছে।”

“কিন্তু বাকি ছয়শ' প্রজাতির খুবই দুর্দিন, যারা মানুষকে এড়িয়ে চলে, নিভৃতে থাকতে চায়। তারা খাবার সংগ্রহের জন্য প্রকাশ্যে আসলেও প্রজননের জন্য তাদের একদম নিভৃত জায়গা দরকার,” যোগ করেন তিনি।

কিন্তু পাখিরা প্রজননের জন্য জায়গা পাচ্ছে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে এখন পর্যন্ত টিকে থাকা অনেক পাখিকে দশ বছর পরে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

উদাহরণস্বরূপ ইনাম জানান, লাল রঙের পায়রার আকারের কুচকুচি বা রেড হেডেড ট্রোগন পাখিটি বাংলাদেশের সবত্রই ছিল। কিন্তু এখন শুধু সিলেটের লাউয়াছড়া বনে দুই-এক জোড়া টিকে আছে।

“আমাদের ধনেশগুলোও সব শেষ, শুধু কাউ বা পাকড়া ধনেশটা পাহাড়ি বনে দুই-একটা আছে,” উল্লেখ করে তিনি জানান, বনের পাখিদের থাকার জায়গা ও আহার - দুটোই বেশি লাগে।

“কিন্তু আমরা আমরা বন পরিষ্কার করে হয় ক্ষেত করেছি নয়ত বসতি করেছি, ফলে পাখিদের বসবাসের জন্য প্রায় কিছুই থাকছে না,” বলেন সরকারের ওয়াইল্ডলাইফ অ্যাডভাইজরি বোর্ডের এই সদস্য ইনাম।

বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. মো. নিয়ামুল নাসেরও বেনারকে বলেন, “আমরা উন্নয়নের নাম করে কিন্তু কিছুই বাদ দিচ্ছি না। পাখিদের আবাসস্থল বা খাদ্যের যোগান দেওয়া জলাভূমি – সবই দখলে নিয়েছি। এটাই প্রধান হুমকির বিষয়।”

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বহু কীট-পতঙ্গ হারিয়ে যাওয়ার কারণেও অনেক পাখি খাদ্যের অভাবে ভুগছে বলে জানান নিয়ামুল নাসের।

দ্য ইন্টারগভর্নমেন্টাল সায়েন্স-পলিসি প্ল্যাটফর্ম অন বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিস (আইপিবিইএস) নামের জাতিসংঘের এক কমিটি ৬ মে এক প্রতিবেদনে জানায়, দুনিয়ার ৮০ লাখ প্রজাতির প্রাণের মধ্যে মানুষের কারণে ১০ লাখ বিলুপ্তির হুমকির সম্মুখীন।

বিগত একশ বছরে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণির বিলুপ্তির আশঙ্কা শতগুণ বেড়েছে বলেও উল্লেখ করেছে তারা।

তবে ইনাম মনে করেন, আইপিবিইএস একটু কমিয়ে বলেছে, আসল পরিস্থিতি এর চেয়ে বহুগুণ খারাপ।

এ ব্যাপারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপ-মন্ত্রী হাবিবুন নাহার বেনারকে বলেন, “শুধু পাখি নয়, বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা প্রতিটি প্রাণী ও উদ্ভিদ আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। হুমকিতে থাকা প্রতিটি প্রজাতি টিকিয়ে রাখতে বর্তমান সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে।”

“সামাজিক বনায়নে জোর দিয়েছে সরকার। এর ফলে পাখির বাসস্থান ও খাদ্যের সংস্থান বাড়বে,” বলেন হাবিবুন নাহার।

ঢাকার একটি জলাশয়ের পাশের গাছে বসে আছে কয়েকটি চিল। ১৯ জানুয়ারি ২০১৭।
ঢাকার একটি জলাশয়ের পাশের গাছে বসে আছে কয়েকটি চিল। ১৯ জানুয়ারি ২০১৭।
[মেঘ মনির/বেনারনিউজ]

পরিযায়ীদের ঝুঁকি

ইনাম আল হকের মতে যেসব পাখি এক জায়গায় থাকে, তারা স্থানীয় ঝুঁকি মোকাবেলা করা শিখে নেয়। কিন্তু যেগুলো ১০-২০ দেশ ঘুরে বেড়ায় – সর্বত্রই পরিবর্তনের ভয় থাকে।

“হয়ত যে জায়গায় এসে সে নামত, শত শত মাইল উড়ে সেখানে এসে দেখল সেই জলাশয়টা নেই; ভরাট করে ফেলা হয়েছে। অনেক বড় পাখি পানি ছাড়া নামতেই পারে না। আবার নামতে পারলেও খাবার পায় না। যে কারণে ওরাই সবচেয়ে বেশি ধ্বংস হচ্ছে। আর এই ধ্বংসের গতি দ্রুততর হচ্ছে,” বলেন তিনি।

বর্তমানে ১৭৬টি পরিযায়ী পাখি খণ্ডকালের জন্য নিয়মিতভাবে বাংলাদেশে আসে। এর মধ্যে ১৬০টি শীতে এবং ছয়টি গ্রীষ্মে এখানে থাকে; বাকি ১০টি বসন্তে এদেশে আসে। তবে এক সময় এখানে ৩২০ থেকে ৩৩০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসত বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নিয়ামুল বলেন, “এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি একটা উদাহরণ হতে পারে। সেখানে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমেছে মানুষের কারণে। হাওরের জমিতে ফসল ফলানোর সময় কীটনাশকের ব্যবহার পাখিদের খাবার নষ্ট করছে।”

“জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকের পরিযায়ী পাখিদের নিয়ে গবেষণা করেও দেখা গেছে যে অংশে শামুক আছে, শুধু সেখানেই তারা আছে, অন্যত্র নেই,” বলেন তিনি।

দরকার গবেষণা

“এই দেশের পাখি নিয়ে অনেক গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। কারণ পরিস্থিতি না জানলে আমরা পাখিদের রক্ষাও করতে পারব না। তাই রক্ষা করতে হলে আগে জানতে হবে,” বলেন ইনাম আল হক।

‘বাংলাদেশের পাখির ফিল্ডগাইড’ গ্রন্থের লেখক ইনাম ‘বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ’এর পাখি বিষয়ক (২৬তম) খণ্ডের সম্পাদক। পাখি বিষয়ক আরো বহু গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি তিনি দেশের সাতশ প্রজাতির পাখির প্রমিত বাংলা নামের তালিকা প্রস্তুত করেছেন, যা জাতীয়ভাবে স্বীকৃত।

তিনি বলেন, “২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে ‘বার্ড রিংগিং’ (পাখিকে পরিচয়লিপি প্রদান) শুরু হয়েছে। গত ১০ বছরে সাত হাজার পাখির শরীরে ট্রান্সমিটারসহ ট্যাগ লাগানো হয়েছে, যার মধ্যে সাড়ে ছয় হাজারই পরিযায়ী পাখি।”

এই ‘রিংগিং’ কার্যক্রমের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার একটি শক্তিশালী ভিত তৈরি করতে পেরেছে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব। ১৯৯৬ সালে ক্লাবটি প্রতিষ্ঠার আগে দুই-তিনজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ছাড়া কেউ পাখি নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী ছিলেন না।

পাখি বিষয়ে “সরকারি পর্যায়ে অনেক ভালো ভালো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেমন বাংলাদেশ পাখি মারা একদম ঢালাওভাবে বেআইনি। যেটা খুব কম দেশেই আছে। এখানে একটা চড়ুই মেরেও আপনি এক বছরের জন্য জেলে যেতে পারেন,” মন্তব্য করলেও ইনামের মতে “বাংলাদেশের ওয়াইল্ডলাইফ অ্যাডভাইজরি বোর্ড শক্তিশালী নয়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।