পরিবেশের ক্ষতি কমাতে রোহিঙ্গা শিবিরে সাড়ে সাত লাখ বৃক্ষরোপণ
2019.08.02
কক্সবাজার
রোহিঙ্গা বসতিকে কেন্দ্র করে গত দুই বছরে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে পরিবেশের যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে, তা কিছুটা পুষিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে শরণার্থী শিবিরগুলোর ভেতর–বাইরে বিভিন্ন প্রজাতির সাড়ে সাত লাখ গাছের চারা লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনটি আন্তজার্তিক সংস্থা পরিচালিত ‘সেফ প্লাস’ কর্মসূচি এবং আরও কিছু বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগে এই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বর্ষাকালজুড়ে চলবে বলে জানিয়েছেন ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) মুখপাত্র সৈকত বিশ্বাস।
গত ৩ জুলাই কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ থেকে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের চাপে এখানকার ৬ হাজার একরের বেশি বনভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে। যে কারণে হুমকির মুখে পড়েছে এখানকার বন ও পরিবেশ।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, টাকার হিসাবে বনজদ্রব্য এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
আইএসসিজির হিসেবে, বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস করছে।
রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে পাহাড়ধসের ঝুঁকি কমাতে তিন বছর মেয়াদি ‘সেফ প্লাস’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে জাতিসংঘের তিনটি সংস্থা; আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম), কৃষি ও খাদ্যবিষয়ক সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্বখাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)।
বনায়নের পাশাপাশি বনাঞ্চল উজাড় ঠেকাতে তারা জ্বালানি কাঠের বিকল্প হিসেবে এক লাখ ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারে এলপিজি গ্যাস সরবরাহ করছে। ২০১৮ সালের মার্চ থেকে এই কর্মসূচি চলমান রয়েছে।
সৈকত বিশ্বাস বেনারকে বলেন, আইওএম, এফএও এবং ডব্লিউএফপি ছাড়াও বনায়ন কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা—ইউএনএইচসিআর, ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো বাংলাদেশ (বিএটিবিসি) এবং দেশি–বিদেশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। সরকারি সহায়তায় জুলাই ও আগস্টজুড়ে বনায়ন কর্মসূচি পুরোদমে চলবে বলে জানান তিনি।
“গত বর্ষা মৌসুমেও রোহিঙ্গা শিবিরের ভেতর–বাইরে বিভিন্ন প্রজাতির ৩ লাখ ৬৮ হাজার চারা লাগানো হয়েছিল। এ বছর লাগানো হচ্ছে তার দ্বিগুণ,” যোগ করেন সৈকত।
গত জুনের শেষভাগে কক্সবাজারের স্থানীয় সাংবাদিকদের নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সেফ প্লাস-এর আইওএম ইউনিটের প্রধান প্যাট্রিক কেরিগনন বলেন, এখন পর্যন্ত এই কর্মসূচি খুবই সফল। কিন্তু তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পে পর্যাপ্ত অর্থ সহায়তা পাওয়া যায়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে সহায়তা পাওয়া গেছে, তা ৩০ শতাংশেরও কম।
ওই অনুষ্ঠানে ডব্লিউএফপির ইমারজেন্সি কো-অর্ডিনেটর (ইসি) পিটার গেস্ট জানান, “২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল তৈরির জন্য বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। বনের এই ক্ষয়ক্ষতি পুনরুদ্ধারে আমরা পুনঃ বনায়নের উদ্যোগ নিয়েছি।”
পুরো ক্ষতি কোনোদিনও পূরণ হবে না
উখিয়ার কুতুপালং, মধুরছড়া ও লম্বাশিয়া শরণার্থী শিবির সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড় ধস ঠেকাতে পাহাড়ের ঢালুতে লাগানো হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, দেওয়া হয়েছে বাঁশের বেড়া। আর সেখানেই লাগানো হচ্ছে, সেগুন, গর্জন, নিমসহ নানা প্রজাতির গাছ আর সবুজ ঘাস।
উখিয়ার মধুরছড়ার ক্যাম্প-১৭ এর হেড মাঝি মো. আবু তাহের বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা এসব এলাকায় যখন আসে, তখন ছোট–বড় অনেক গাছ ছিল। নানা কারণে এগুলো কাটা পড়েছে। কেউ ঘর তৈরির জন্য গাছ কেটেছে, কেউবা জ্বালানি হিসাবে ব্যবহারের জন্য গাছ কেটেছে। নানা কারণে এলাকাটি গাছ শূন্য।”
রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস-এর চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ বেনারকে বলেন, “গাছগুলো বড় হলে কিছুটা হলেও পরিবেশের ক্ষতি কেটে যাবে। এ জন্য রোহিঙ্গাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।”
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. হুমায়ুন কবীর বেনারকে বলেন, মূলত ২০টি আন্তজার্তিক সংগঠন বৃক্ষ রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে। যেসব গাছ আগে সেখানে ছিল সেগুলো লাগানোর পরামর্শ দিয়েছে বন বিভাগ।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে, চাপালিস, গর্জন, সেগুন, জারুল, শিউলি, তেলসুর, কড়ই, কদম, বাটানা। তবে উদ্যোক্তাদের ফলের গাছ না লাগাতে বলা হয়েছে।
এ কর্মসূচির কারণে বনের ক্ষতি কতটা কমবে—এমন প্রশ্নের জবাবে ওই বন কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের চাপে বনের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা কোনদিনও পূরণ হবে না। এখন যে চারাগুলো লাগানো হচ্ছে, দেখা যাবে সেগুলো রোহিঙ্গারাই আবার কেটে ফেলবে।
গত ৩ জুলাই কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর গত দুই বছরে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের ৬ হাজার ২০০ একর বন ধ্বংস হয়েছে। যার মধ্যে দুই হাজার ২৭ একর সৃজিত আর চার হাজার ১৩৬ একর প্রাকৃতিক বন ছিল।
প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপনের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এ কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী সৃজিত এবং প্রাকৃতিক বনের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪৫৬ কোটি টাকা। একইভাবে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। আর বনজদ্রব্য এবং জীববৈচিত্র্যের মোট ক্ষতি ১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন আরও বলছে, কক্সবাজার জেলার পাহাড়গুলো প্রধানত নরম ও দোআঁশ মাটির হওয়ায় মাটির কাঠিন্য বা দৃঢ়তা কম। উখিয়া ও টেকনাফে পাহাড় ও বনভূমি কেটে অপরিকল্পিত রোহিঙ্গা বসতি গড়ে তোলায় বর্ষায় পাহাড়ধসের আশঙ্কা রয়েছে।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বেনারকে বলেন, রোহিঙ্গারা আসার পর বনভূমির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি কোনওভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে বড় পরিসরে বনায়নের উদ্যোগ নেওয়ার লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা হলেও কমানোর চেষ্টা করা।