গবেষণা প্রতিবেদন: বায়ুদূষণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় সাড়ে ৫ বছর
2021.09.01
ঢাকা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশিকা মেনে বায়ুদূষণ কমিয়ে আনতে পারলে বাংলাদেশে গড় আয়ু প্রায় সাড়ে ৫ বছর বাড়বে। বুধবার শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইন্সটিটিউট (ইপিআইসি) প্রকাশিত সর্বশেষ ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স’ এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বায়ু দূষণের কারণে সারা দেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। আর রাজধানী ঢাকায় তা কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর ছয় মাস। লাইফ ইনডেক্সের গবেষণা মতে, বায়ু দূষণ না থাকলে তা ৭৭ বছর ১০ মাস হতো।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ু দূষণের কারণে ১৯৯৮ সালে গড় আয়ু কমেছিল প্রায় দুই বছর আট মাস, যা ২০১৯ সালে পাঁচ বছর চার মাসে দাঁড়ায়।
দেশের ৬৪টি জেলার প্রতিটিতে বায়ু দূষণের মাত্রা ডব্লিউএইচও-এর সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় কমপক্ষে তিনগুণ বেশি বলে জানানো হয় প্রতিবেদনে।
এই প্রতিবেদনের তথ্যের সঙ্গে অনেকটাই সহমত প্রকাশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হুমায়ুন কবীর।
তিনি বেনারকে বলেন, “আমাদের শহরগুলোতে ঘনবসতি বেশি। আছে অপরিকল্পিত নগরায়ন, যা পরিবেশে দূষণের জন্য দায়ী। এ ছাড়া রাস্তাঘাটগুলো ঠিকমতো কার্পেটিং করা হয় না। এতে করে শুকনো মৌসুমে কার্পেটিং উঠে গিয়ে প্রচুর ধুলাবালি তৈরি হয়। ফলে বাতাসে ধূলিকণা ভয়াবহ মাত্রায় থাকে। অবকাঠামো নির্মাণের কারণেও পরিবেশ দূষণ বাড়ছে।”
পুরোনো গাড়ি চলাচলও “বায়ু দূষণের অন্যতম আরেকটি কারণ,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পুরাতন যানবাহন প্রচুর কালো কার্বন ছড়ায়, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত খারাপ। মুক্ত বাতাসে বর্জ্য ডাম্পিং করার ফলেও বায়ু দূষণ বাড়ছে।”
এই পরিবেশবিদ বলেন, “নগরায়ন বাড়তে থাকায় বেড়েছে অপরিকল্পিত ইটের ভাটা। শুধু ঢাকা শহরের আশেপাশেই অন্তত এক হাজার ইটের ভাটা রয়েছে। যেখান থেকে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন, সালফার ডাই অক্সাইডসহ নানা ধরনের বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। আর পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তো আছেই।”
“তাই বেঁচে থাকার জন্য এসব বিষয়ে আমাদের আমাদের নীতি নির্ধারকদের আরো বেশি নজর দিতে হবে,” মনে করেন ড. হুমায়ুন কবীর।
বায়ু বেশি দূষিত করে গাড়ি ও বিদ্যুৎকেন্দ্র
লাইফ ইনডেক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধূমপান, এইচআইভি (এইডস), দূষিত পানি ও অপর্যাপ্ত পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার চেয়ে বায়ুদূষণ মানবস্বাস্থ্যে বেশি প্রভাব ফেলছে। দূষিত বাতাসে কঠিন ও তরল পদার্থ উড়ে বেড়ায়, যার মধ্যে রয়েছে কাচ, ধোঁয়া বা ধুলা।
এতে বলায় হয়, বস্তুকণাগুলোর মধ্যে ‘বস্তুকণা ২.৫’ নামে পরিচিত কণাটি সবচেয়ে প্রাণঘাতী, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে যায়। এই দূষণ সবচেয়ে বেশি হয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে, যা মূলত গাড়ির ইঞ্জিন বা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপন্ন হয়।
গত মার্চে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ‘বস্তুকণা ২.৫’ এর পরিমাণ ৭৭.১ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের চেয়ে সাত গুণ বেশি। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ বায়ু দূষণে বিশ্বে শীর্ষস্থানে ছিল এবং রাজধানী হিসেবে ঢাকা ছিল দ্বিতীয় স্থানে। ২০১৯ সালে দেশের প্রতি ঘন মিটার বাতাসে ৬৫.৫ মাইক্রোগ্রাম বস্তুকণার উপস্থিতি ধরা পড়ে।
এ বছরের এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ ভারত।
ইপিআইসি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের দূষিত বিভাগ খুলনা ও রাজশাহী। এই দুটি বিভাগের বায়ু দূষণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে সাতগুণ বেশি। ফলে এই বিভাগের বাসিন্দাদের গড় আয়ু ৬ বছরের বেশি কমছে।
জাতীয় গড়ের চাইতে বাতাসের মান সবচেয়ে ভালো থাকলেও চট্টগ্রাম বিভাগের বাসিন্দাদের গড় আয়ু কমেছে ৩.৬ বছর। বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত জেলাগুলো হলো, খুলনা, রাজশাহী, যশোর, নারায়ণগঞ্জ, পাবনা, ঢাকা এবং গাজীপুর। এ সব জেলায় বস্তুকণা ২.৫ এর ঘনত্ব জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক বেশি।
সবচেয়ে বেশি হয় শ্বাসতন্ত্রের রোগ
“বায়ু দূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি হয় শ্বাসতন্ত্রের রোগ। এর মধ্যে হাঁপানি, ফুসফুসের কাশি ছাড়াও ফুসফুস ক্যানসার, স্ট্রোক ও কিডনির সমস্যা হয়,” বলে বেনারকে জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী।
তবে পরিবেশ বন ও জলবায়ু বিষয়ক উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বেনারকে বলেন, “পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু এই দূষণের সাথে কোনো একটি ডিপার্টমেন্ট, মন্ত্রণালয় জড়িত না।”
তাঁর মতে, “এর সাথে সাধারণ মানুষ থেকে শিল্পপতি অর্থাৎ দেশের প্রায় সব মানুষ জড়িত। এমনকি সরকারের যেসব মেগা প্রকল্প চলছে সেগুলোও পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী।”
তিনি বলেন, “যখন মেগা প্রকল্পগুলো নেয়া হয়, তখন পরিবেশ দূষণ করবে না—এমন শর্ত মেনে নেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে তারা কোনো নিয়ম মেনে চলে না। ফলে দূষণ বাড়তে থাকে। কিন্তু সবগুলো প্রকল্প, কারখানা দেখভাল করার জনবল আমাদের নেই। এটাই চরম বাস্তবতা।”
“পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও সামাজিকভাবে পলিথিন সর্বত্র ব্যবহার হচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিগুলো নদীনালা দূষণ করে যাচ্ছে। ইটভাটা ভেঙে ফেলার পরেও কয়েকদিনের মাথায় আবারও তা গড়ে উঠছে। অন্য কারো প্রভাবে তারা এসব কাজে প্রশ্রয় পেতে পারে,” বলেন হাবিবুন নাহার।
উপমন্ত্রী বলেন, “আমরা চেষ্টা করেছিলাম অন্তত সংসদ ভবনের চারপাশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু পারিনি। অথচ এই গাড়ির চালকেরা যখন সেনা নিয়ন্ত্রিত সেনানিবাস এলাকায় ড্রাইভিং করে তারা সকল নিয়ম মেনে চলে। আসলে সাধারণ মানুষকে পরিবেশের গুরুত্ব বুঝতে হবে। তখনই আসলে এর দূষণ দূর করা সম্ভব।”
ইপিআইসি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ু দূষণের কারণে সারা বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু কমেছে ২ বছর ২ মাস। স্থায়ীভাবে দূষণ বন্ধ করা গেলে বিশ্বের মানুষের গড় আয়ু ৭২ থেকে ৭৪ বছর হতো, যা সব মিলিয়ে ১৭ বিলিয়ন জীবন-বর্ষ।
গবেষণাটি বলছে, কঠোর নীতির মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানি নিঃসরণ কমানো যেতে পারে এবং এটি জলবায়ু প্রশমিত করতেও সাহায্য করে যা আয়ু বৃদ্ধিতে কার্যকর।