বাংলাদেশের মতে সদ্য সমাপ্ত জলবায়ু সম্মেলন ‘ব্যর্থ’ নয়

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.11.16
ঢাকা
বাংলাদেশের মতে সদ্য সমাপ্ত জলবায়ু সম্মেলন ‘ব্যর্থ’ নয় ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ভেঙে যাওয়ার পর নতুন করে বাঁধ তৈরি হলেও বহু মানুষের ঘরবাড়ি এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। ছবিটি খুলনার কয়রা উপজেলা থেকে তোলা। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ।
[জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ]

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে সদ্য সমাপ্ত জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ ‘ব্যর্থ’ বলে বিশ্বের বিভিন্ন পরিবেশবাদী গ্রুপ মত প্রকাশ করলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন।

সম্মেলনে যোগ দেয়া সরকারি কর্মকর্তারা ঢাকায় ফিরে বলছেন, এই সম্মেলন ব্যর্থ নয় এবং সেখানে এমন কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা অতীতের কোনো সম্মেলনে হয়নি। যদিও বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনকে সফল বলতে নারাজ।

বিশ্বের শীর্ষ পরিবেশবাদী সুইডেনের গ্রেটা থানবার্গ কপ-২৬ কে ব্যর্থ বলে আখ্যায়িত করে গ্লাসগোতে শত শত মানুষের বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছেন। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর গ্লাসগো সম্মেলনে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন। তবে মূল আলোচনায় অংশ নেন পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন আহমেদ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

ব্যর্থ নয়

গ্লাসগো সম্মেলনে বাংলাদেশ দলের কারিগরি সহায়তা প্রদানকারী অন্যতম কর্মকর্তা ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্লাইমেট সেলের পরিচালক মির্জা শওকত আলী মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আমি বলব না যে গ্লাসগো সম্মেলন ব্যর্থ হয়েছে। এই সম্মেলনে অনেক কিছু হয়েছে যা আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে চাই।”

“প্রথম কথা হলো, প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য এই চুক্তির আওতায় একটি রুলবুক হওয়ার কথা ছিল এবং সেটি সম্পন্ন হয়েছে। এই রুল বুকের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য যে প্রতিশ্রুতি দেবে সেগুলো খতিয়ে দেখবেন বিশেষজ্ঞরা,” বলেন মির্জা শওকত।

ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বাংলাদেশের “অন্যতম দাবি জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে আমাদের খাপ খাইয়ে নেয়ার (অ্যাডাপটেশন) ব্যবস্থা করা,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “গ্লাসগো সম্মেলনে প্রথমবারের মতো বার্ষিক অ্যাডাপটেশন ফান্ডের পরিমাণ সর্বোচ্চ ১২৯ মিলিয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি করে ৩৫৬ মিলিয়ন ডলার করা হয়েছে। এই তহবিল থেকে আমরা অর্থ পাব।”

তিনি বলেন, “অ্যাডাপটেশনের ব্যাপারে প্রতিটি সম্মেলনে কথা বলা হলেও এর লক্ষ্য স্থির করা হয়নি। এই সম্মেলনেই প্রথমবারের মতো গ্লাসগো-শার্ম-আল-শেখ নামের একটি কর্মসূচি অনুমোদন করা হয়েছে। এই কর্মসূচির আওতায় বৈশ্বিক অ্যাডাপটেশনের লক্ষ্য স্থির করা হবে, যার মাধ্যমে অ্যাডাপটেশন কার্যক্রমকে কাঠামোবদ্ধ করা যাবে এবং তাতে আমরা উপকৃত হব।”

এই সম্মেলনেই প্রথমবারের মতো ক্ষতিগ্রস্ত স্বল্পোন্নত দেশের জন্য তহবিলের পরিমাণ ১৮৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে উন্নীত করে ৪৩১ মিলিয়ন ডলার করা হয়েছে। এই তহবিল থেকেও বাংলাদেশ অর্থ পাবে বলে জানান তিনি। কারণ “বাংলাদেশ এখনও স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে যায়নি।”

তিনি বলেন, এই সম্মেলনে “ভারত ও চীনের আপত্তির কারণে” ধীরে ধীরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া না গেলেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি এসেছে।

“এই সম্মেলনে আমাদের জন্য খারাপ কিছু হয়নি,” জানিয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের আরেক সদস্য ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বেনারকে বলেন, “যদিও আমাদের জন্য আরো ভালো কিছু হলে ভালো হতো।”

তিনি বলেন, “বিশ্বের কাছে আমাদের মূল দাবি ছিল: প্যারিস চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন। বিশ্বে গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমানো। এই চুক্তির আওতায় বিশ্বের সব দেশকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি সর্বোচ্চ এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে। এই সম্মেলনে সেই আশা বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।”

“এই সম্মেলনে আমরা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছি, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হয়েও ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের গ্রিন হাউস গ্যাসের শতকরা ২১ ভাগ কমাব,” বলেন জিয়াউল হক।

লস অ্যান্ড ড্যামেজে অগ্রগতি নেই

ঢাকা ভিত্তিক বেসরকারি সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এর পরিচালক মিজান আর খান বেনারকে বলেন, গ্লাসগো সম্মেলনে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য তহবিল এবং অ্যাডাপটেশেনর তহবিলের ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি হয়েছে।

এর আগে ২০১০ সালে মেক্সিকোর কানকুনে উন্নত বিশ্বের পক্ষ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিগ্রস্তদের দেবার কথা বলা হলেও সেই প্রতিশ্রুতি আজও বাস্তবায়িত হয়নি বলে জানান তিনি।

“এই জন্য উন্নত বিশ্বের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। তারা দুঃখ প্রকাশ করছে কিন্তু পকেট খুলছে না,” বলেন ড. মিজান।

তিনি বলেন, “উন্নত বিশ্বের পক্ষ থেকে বলা হয় ৭৯ বিলিয়ন ডলার সংস্থান করা হয়েছে। কিন্তু তারা একই টাকা বিভিন্ন হিসাবে দেখিয়ে এই হিসাব দেয়। সেকারণে আমাদের দাবি, কোনটি জলবায়ু তহবিল এবং কোনটি বৈদেশিক সাহায্য সে বিষয়টি স্পষ্ট করা দরকার।”

ক্লাইমেট ভালনারেবল কান্ট্রি গ্রুপের পক্ষ থেকে লস অ্যান্ড ড্যামেজ খাতে অর্থ বরাদ্দ করতে একটি চাপ ছিল, বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে চাপ দেয়া হয়েছে জানিয়ে ড. মিজান বলেন, “সম্মেলনে বলা হয়েছে, লস অ্যান্ড ড্যামেজের ব্যাপারে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।”

বনভূমি উজাড় বন্ধে আন্তর্জাতিক ঘোষণায় বাংলাদেশ

পরিচালক মির্জা শওকত আলী বলেন, এই সম্মেলনে বনভূমি উজাড় রক্ষার্থে একটি আন্তর্জাতিক ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ, যার মাধ্যমে দেশে বনভূমি ধ্বংস রক্ষা করা যাবে বলে আশা করা যায়।

তবে বাংলাদেশ মিথেন কমানো সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিতে যোগ দেয়নি বলে তিনি জানান।

বাংলাদেশ-মার্কিন সরকারের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত আরণ্যক ফাউন্ডেশনের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বলছে দেশে বনভূমির পরিমাণ ১২ দশমিক আট ভাগ।

তিনি বলেন, “তবে, আমরা বনে গিয়ে দেখতে পাই গাছের অবস্থা খুব খারাপ। বনে গাছ নেই বললেই চলে। তাই প্রকৃত বনভূমির আয়তন অনেক কম।”

ফরিদ উদ্দিন বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে বার বার করে বলা হচ্ছে, বনভূমি বৃদ্ধি করা হবে। কিন্তু বনভূমি বৃদ্ধি করবে কীভাবে, তা আমরা বুঝি না। সরকার বনের জমিতে বিভিন্ন কলকারখানা স্থাপনেরও অনুমতি দিচ্ছে।”

“সরকারি বিভাগগুলোও বন রক্ষার জন্য নিষ্ঠার সাথে কাজ করছে না। এমনকি জনগণও বন রক্ষায় খুব আন্তরিক নয়,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা যদি মোট ভূমির শতকরা ১৬ ভাগ বনভূমি রাখতে পারতাম তাহলে ভালো হতো।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।