জাল নোটের বিস্তার রোধে যৌথভাবে কাজ করবে বাংলাদেশ-ভারত
2017.12.18
ঢাকা

দ্রুত গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে জাল নোটের বিস্তার রোধে একযোগে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
রোববার থেকে ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে শুরু হওয়া জাল নোট সম্পর্কিত দুদেশের যৌথ টাস্ক ফোর্সের সভায় বলা হয়, দুদেশ যেভাবে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ কার্যক্রম মোকাবিলা করে সফল হয়েছে একইভাবে সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত জাল নোটের বিস্তার রোধ ও অবৈধ-মুদ্রা পাচারও বন্ধ করবে।
সভায় বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন উপমহাপরিদর্শক (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) রৌশন আরা বেগম। ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির (এনআইএ) মহাপরিদর্শক শ্রী অনিল শুক্লা। সভায় দু’দেশের ২৬ জন কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন ও অপারেশনস্) মোঃ মোখলেসুর রহমান সভা উদ্বোধন করেন। তিনি বলেন, “জাল নোট একটি আন্তঃদেশীয় অপরাধ। এককভাবে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়।”
“জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ ও ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় অপরাধ দমন সহজ হয়েছে। এ সহযোগিতা বিদ্যমান থাকলে দু’দেশই উপকৃত হবে,” বেনারকে বলেন মোখলেসুর রহমান।
ভারতীয় প্রতিনিধি দলের প্রধান এনআইএ’র মহাপরিদর্শক অনিল শুক্লা সাংবাদিকদের বলেন, জাল নোটের বিস্তার রোধে যৌথভাবে কাজ করা প্রয়োজন।
“দুই দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য জাল নোটের বিস্তার রোধ জরুরি,” বলেন তিনি।
বৈঠকে জাল নোটের উৎস চিহ্নিত করা এবং জাল নোট তৈরি ও বিতরণকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দু’পক্ষই তাৎক্ষণিক গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ে সম্মত হয়েছে। এক্ষেত্রে দু’দেশের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে টাস্কফোর্স।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের মার্চে বাংলাদেশ থেকে প্রথমে একটি দল যাবে ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে। সে সময় ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সফরসূচি চূড়ান্ত হবে।
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসায়িক সম্পর্কও
জাল নোটের পাচার আন্তর্জাতিক সস্ত্রাসবাদ বিষয়ক অপরাধসমূহের একটি। দু’দেশই স্বীকার করেছে জাল নোট তাদের জন্য নানা কারণে সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
উদ্বেগের জায়গাগুলো কী জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক সহেলী ফেরদৌস সভায় আলোচিত বিষয় সম্পর্কে জানান, জাল নোট মূল অর্থবাজারে ঢুকে যাওয়ার একটা আশঙ্কা আছে।
“এমন ঘটনাও ঘটছে যে বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে চিকিৎসা করাতে গিয়ে বা বেড়াতে গিয়ে ফেরত এসেছেন জাল নোটের কারণে। ব্যবসায়িক সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে,” বলেন সহেলী ফেরদৌস।
গত ১২ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সংবাদপত্র হিন্দুস্তান টাইমস এ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ভারতের জম্মু, পাঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাট, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়ের ১৩ টি পয়েন্ট থেকে ভারতীয় জাল টাকা বাংলাদেশে ঢুকছিল। ১১টি পয়েন্টে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলেও বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে এ বছরের জানুয়ারি থেকে পাচার হওয়া টাকার পরিমাণ বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদরদপ্তরের উপকমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “২০১২ সাল থেকে ১০ কোটি রুপির মতো জাল টাকা উদ্ধার করেছে বাংলাদেশের পুলিশ। তবে ওই প্রান্ত থেকে বাংলাদেশে কী পরিমাণ বাংলাদেশি জাল টাকা ঢুকছে সে তথ্য এখনও আমরা হাতে পাইনি।”
তবে এর আগে বাংলাদেশ থেকে দুই টাকার নোটের বড় চালান বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার পথে পুলিশের হাতে আটক হয়। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গতবছর চীনে পাচারের সময়ও বাংলাদেশি জাল টাকা উদ্ধার হয়েছিল।
নেশার কাজে বাংলাদেশের নোট
“বাংলাদেশের দুই টাকার নোটগুলো আকারে ছোট। ভারতে এই নোটগুলো মাদক সেবনের কাজে ধোঁয়া তৈরিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। মাদকাসক্তদের কাছে বিশেষ চাহিদা থাকায় নোটগুলো পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে আমরা খবর পাচ্ছি,” বেনারকে বলেন বেনাপোল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অপূর্ব হাসান।
গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রী ও জুরাইন এলাকা থেকে কোটি টাকার জাল নোট ও জাল নোট তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে র্যাব।
ওই ঘটনায় আটককৃতদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব জানতে পারে, এই কাজে ভারতীয়রা বাংলাদেশি অপরাধীদের সহযোগিতা করছে। জাল টাকার কাগজ ও মিহি নিরাপত্তা সুতা আনা হচ্ছিল ভারত থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বেনারকে বলেন, “জাল টাকা দেশি বা বিদেশি হোক, তা অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। একইসঙ্গে জাল মুদ্রা দরিদ্র ও সাধারণ মানুষদের সরাসরি ক্ষতি করে।
“টাকা জালকারীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। তবে জানি না কেন জাল টাকার মামলার বিচার দ্রুত হয় না। সেই সুযোগে জালিয়াতরা এই অপরাধ চালিয়ে যেতে সাহস পায়,” বলেন তিনি।
পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে জাল মুদ্রার বিরুদ্ধে আইনের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আইন অনুযায়ী যিনি জাল টাকা বহন করবেন তার বিরুদ্ধে মামলা হবে।”
“যিনি জাল টাকা চেনেন না তাকে যদি কেউ জাল টাকা গছিয়ে দেয়। আর সেজন্য যদি নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, শাস্তি দেয়া হয় তাহলে তো আর বিচার হলো না,” তাঁর আক্ষেপ।
তিনি বলেন, “আবার জাল টাকার মামলাগুলোর পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সাক্ষীরা আদালতে হাজির হতে চায় না। তাই, অপরাধকারীরা পার পেয়ে যায়।”