গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী মামলা ঘিরে দুর্নীতি-চাঁদাবাজি

ঢাকার গাড়িচালক হাফিজুর রহমান সুমনকে গত ৫ আগস্ট রাজধানীর শেরেবাংলা নগর মহিলা কলেজের সামনে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ আগস্ট মারা যান তিনি।

স্বামীর মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী-এমপিসহ ৬৯ জনকে আসামি করে মামলা করেন তার স্ত্রী বিথি খাতুন। তিনি বেনারকে বলেন, ওই মামলায় ৬৯ জনকে আসামি করলেও শেখ হাসিনাসহ ৫-৬ জন ছাড়া কাউকে তিনি চেনেন না।

তাহলে কেন আসামি করেছেন? জবাবে বিথি বেনারকে জানান, “স্থানীয় এক বিএনপি নেতার পরামর্শে বাকিদের আসামি করেছি।”

তবে টেলিফোনে একাধিকবার কথা বলা এবং সামনাসামনি দেখা করার পরও বিথি স্থানীয় ওই বিএনপি নেতার নাম প্রকাশ করেননি।

হত্যা মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ও শেরেবাংলা নগর থানার উপ-পরিদর্শক ছাব্বির আহমেদ বেনারকে বলেন, “বাদী কয়েকদিন পরপর ফোন করে একে গ্রেপ্তার করা যাবে না, তাকে ধরতে হবে-এসব কথা বলছেন। কিছু ঝামেলা বুঝতে পারছি, যা তদন্তের পর বলা যাবে।”

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট তেজগাঁও বিভাগের একজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন, মামলাটি বাদী বুঝে বা না বুঝে বেচে দিয়েছেন মিরপুর বিএনপি’র স্থানীয় এক নেতার কাছে। মূলত ওই নেতা বাদীকে কিছু সুবিধা দিয়ে যাকে-তাকে গ্রেপ্তার করতে বলছেন।

তবে বিথি খাতুন বলেন, ‘চাঁদাবাজির’ বিষয় তিনি জানেন না। তিনি যেহেতু কাউকে চেনেন না, সেহেতু মামলা করার ক্ষেত্রে পরিচিত এক নেতার পরামর্শ নিয়েছেন।

“আসলে আমি মামলা করতেই রাজি ছিলাম না। স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন নেতার অনুরোধে এবং এক নেতার সহায়তায় আমি মামলার বাদী হয়েছি,” বলেন তিনি।

আড়াই হাজার রাজনৈতিক মামলা , বেশিরভাগই প্রশ্নবিদ্ধ

পুলিশ সদর দপ্তরের হিসেবে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে রাজনৈতিক মামলার সংখ্যা এখন প্রায় আড়াই হাজার।

বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের নভেম্বরের প্রতিবেদন বলছে, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা, পূর্ব শত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা এবং চাঁদাবাজি ও হয়রানি করতে অনেককে আসামি করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে পুলিশ বাদী হয়ে অসংখ্যা ‌‘ভুয়া’ মামলা করায় তা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন ও বিরোধী দলগুলো আপত্তি ও উদ্বেগ জানায়। পুলিশের দায়ের করা এসব মামলায় বিরোধীদের দমন-পীড়ন করার অভিযোগ ছিল। এখন পুলিশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু টাউট-বাটপার।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মূলত চাঁদাবাজি করতেই ঢালাওভাবে কয়েকশ ব্যক্তিকে এসব মামলায় আসামি করা হচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় রোগব্যাধি বা দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিকে নিয়ে মামলায় আসামি করে চাঁদা চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

81bc2249-2e2f-4bec-8a54-4fc00eca9174.jpeg
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে নাশকতার ঘটনায় আটককৃত বিএনপি নেতাকর্মীদের ঢাকার সিএমএম কোর্টে আনা হয়। ২৫ জুলাই ২০২৪। [মেহেদী রানা/বেনারনিউজ]

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার ৬৪ বছর বয়সী দুলাল রবি দাস এমনই একজন। তিনি জুতা সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই তিনি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যান।

প্রায় সাড়ে চার মাস পর ২৯ নভেম্বর রবি দাসের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন রফিউল আলম নামের এক ব্যক্তি। অভিযোগ করা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় দুলালকে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ সমর্থকরা হত্যা করেছে। মামলায় আসামি ৪৫০, নাম উল্লেখ আছে ১৬৮ জনের।

মৃত রবি দাসের ছেলে বিকাশ দাস বেনারকে বলেন, “কিভাবে মামলা হলো, কিছুই জানতে পারিনি। তবে মামলার পর কিছু আসামির কাছে মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার জন্য অর্থ চাওয়া হয়েছে। আমি চাই না, কেউ আমার বাবার নাম ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার করুক।”

দুলালের আরেক ছেলে বিকাশ দাস ইতোমধ্যে কিশোরগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কাছে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন।

বিকাশ বেনারকে জানান, “আমার বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল।"

বাবার চেয়ে দরদি এক বাদী!

বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থেকেও রেহাই পাননি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রকি ভূঁইয়ার পরিবার।

“আমার ভাইসহ বিএনপির নয়জন নেতাকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে চাঁদা আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে,” বলেন রকি।

মামলার বাদী রফিউল আলম এজাহারে দুটি হত্যাকাণ্ড ও তার নিজের আহত হওয়ার কথা বলেছেন। এজাহারে অন্য হত্যাকাণ্ডে নিহত হিসেবে মো. রুবেল মিয়ার (৩৪) কথা বলা হয়েছে, যাকে ৪ আগস্ট সরকারবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গুলি করে হত্যার দাবি করা হয়।

তবে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের মৃত্যু সনদ অনুযায়ী, রুবেল হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।

রুবেলের বাবা আজহারুল ইসলাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মামলাটি বাতিলের আবেদন করেছেন।

মামলায় আসামি করে টাকা চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন বেনারকে বলেন, “বাদী গণঅধিকার পরিষদের সমন্বয়ক এবং আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। টাকা চাওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই।”

বাদী রফিউল নিজেকে গণআন্দোলনের ‘যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচয় দেন। যদিও তিনি এখন আর গণঅধিকার পরিষদের পদে নেই বলে জানান।

রফিউলের মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং তিনি তাদের নাম বাদ দেওয়ার জন্য অর্থ দাবি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

বেনারনিউজ রফিউল এবং এক আসামির আত্মীয়ের কথোপকথনের একটি রেকর্ডিং পেয়েছে। সেখানে রফিউল নাম বাদ দেওয়ার জন্য একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, “আমি তার নম্বর দেব, তবে গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে। আমি সমস্যায় পড়লে আপনাদের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।”

তবে ফোনালাপে অর্থ দাবি করা নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি রফিউল।

কী বলছে পুলিশ-প্রশাসন

পুলিশের মাঠ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলছেন, তদন্তে সময় লাগছে। তবে অভিযোগপত্র জমা না দেওয়া পর্যন্ত নিরীহ ব্যক্তিদের নাম বাদ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আদালতের হস্তক্ষেপ ছাড়া নিরীহ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এখনই কিছু করার নেই।

ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার এস এম সাজ্জাদ আলী মিথ্যা মামলা এবং চাঁদাবাজির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বেনারকে বলেছেন, “কিছু পুলিশ কর্মকর্তা এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট থানাগুলোকে মিথ্যা অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করতে।নির্দেশ দিয়েছি।”

পুলিশের প্রতি ইউনিটে ও জেলায়-জেলায় এসব মামলা তদারকি করে নিরীহ ব্যক্তিদের নাম আসামি তালিকা থেকে বাদ দিতে ও দোষীদের খুঁজে বের করে অভিযোগপত্রে নাম যুক্ত করতে এরই মধ্যে কমিটি করে দেয়া হয়েছে বলে সম্প্রতি বেনারকে বলেন পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম।

ন্যায়বিচার নিয়ে শঙ্কা

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, নিরপরাধ ব্যক্তিদের আসামি করা এবং নাম বাদ দেওয়ার জন্য তাদের কাছ থেকে অর্থ দাবি করায় মূল দোষীরা সাজা পাবে না।

মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর পরিচালক এএসএম নাসিরউদ্দিন এলান বেনারকে বলেন, ঢালাওভাবে কয়েকশো মানুষকে মামলা আসামি করে এক ধরনের চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। এ মামলাগুলো থেকে পুলিশের বিরদ্ধেও চাঁদাবাজিরও অভিযোগ আমরা পাচ্ছি।"

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বেনারকে বলেন, “জুলাই আন্দোলন পরবর্তী মামলাগুলো এখন দুর্নীতির উৎসে পরিণত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করা হচ্ছে, যাদের বেশিরভাগেরই সম্পৃক্ততা ছিল না। তাদের কাছ থেকে নাম বাদ দেওয়ার জন্য অর্থ আদায় করা হচ্ছে।”

“এমন আসামি বেশি থাকলে, সঠিক তদন্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এতে প্রকৃত দোষীরা পার পেয়ে যায়,” যোগ করেন তিনি।