আটকে গেলো হলি আর্টিজান ট্র্যাজেডি নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্র

শরীফ খিয়াম
2019.01.23
ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
190123_BD_bans_film_1000.JPG ঢাকায় ১৭তম মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্রকার মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ৮ মে ২০১৫।
[মেঘ মনির/বেনারনিউজ]

আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯। ইস্টার্ন টাইম: সকাল ১০.০০

ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ইসলামী জঙ্গিদের অস্ত্রের মুখে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি হওয়ার ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ‘শনিবার বিকেল’ চলচ্চিত্রটি আটকে দিয়েছে বাংলাদেশ।

বহির্বিশ্বে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতার শঙ্কায় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের ফিল্ম সেন্সর বোর্ড। তবে বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান নিজামূল কবীর মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “সিনেমাটিকে ‘নিষিদ্ধ’ করা হয়নি। সম্প্রচারের অনুপযুক্ত বিবেচনায় ‘প্রত্যাখ্যান’ করা হয়েছে।”

“এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ৩০ দিনের মধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আপিল করার সুযোগ রয়েছে,” উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, “আবেদন পেলে মন্ত্রী পরিষদ সচিবের নেতৃত্বাধীন আপিল বোর্ড সিনেমাটি দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।”

একইদিন চলচ্চিত্রটির মুখ্য প্রযোজক, জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজ বেনারকে বলেন, “আপিল করার প্রস্তুতি চলছে। আইনজীবীর পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই আপিল করা হবে।” দেশীয় প্রেক্ষাগৃহে সিনেমাটি মুক্তির ব্যাপারে তিনি এখনো আশাবাদী।

সেন্সর বোর্ডের একাধিক সদস্য বেনারকে জানান, আপিল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধদের আদালতে যাওয়ারও সুযোগ রয়েছে।

এদিকে পুরো ঘটনাটি “শৈল্পিক অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য অস্বাস্থ্যকর,” দাবি করে চলচ্চিত্রটির পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বেনারকে বলেন, “আমি বিরক্ত ও ক্লান্ত।”

গত ৯ জানুয়ারি সিনেমাটি দেখে হলি আর্টিজানের ঘটনা অবলম্বনে সিনেমা হচ্ছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন সেন্সর বোর্ডের একাধিক সদস্য। এরপর থেকেই ইসলামী আলেম-ওলামাদের একটি অংশ সিনেমাটির বিরুদ্ধে ওয়াজ-মাহফিলসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল প্রচারণা শুরু করে।

পরবর্তীতে ইসলামপন্থীদের আন্দোলনের মুখে ১৫ জানুয়ারি সিনেমাটি পুনরায় দেখে ‘ছাড়পত্র’ না দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায় সেন্সর বোর্ড। চলচ্চিত্র ও গণমাধ্যম বিষয়ক লেখক ও গবেষক ফাহমিদুল হকের মতে, “দেশের চলচ্চিত্র সেন্সর ব্যবস্থা যে বেহাল বা করুণ দশায় আছে, এই সিদ্ধান্ত তারই প্রতিফলন।”

“এমন সিদ্ধান্ত উদারমনা ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের পরিচিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। কারণ ফারুকীর মতো একজন শিল্পী সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি বা দেশের স্বার্থ বিরোধী কিছু নির্মাণ করেছেন বলে আমার মনে হয় না,” বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।

অন্যদিকে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য ও চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ বেনারকে বলেন, “প্রথম প্রদর্শনীর দিন সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান (তথ্য সচিব আবদুল মালেক) উপস্থিত ছিলেন না। তবে দ্বিতীয়বার ছবিটি দেখার সময় বোর্ডের প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন।”

“এ জাতীয় স্পর্শকাতর চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে বোর্ডের সব সদস্যের পরামর্শ নেওয়া হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত খোদ চেয়ারম্যানই নিয়ে থাকেন,” বলেন তিনি।

সেন্সর বোর্ডের আরেক সদস্য ও চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বেনারকে জানান, তথ্যের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র ও আইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরাও এ চলচ্চিত্রটি দেখেছেন। “মূলত এর বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশাসনিক দিক থেকে বেশ কিছু আপত্তি এসেছিল,” বলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতের জঙ্গি হামলার পটভূমিতে ‘শনিবার বিকেল’ নির্মিত, তাতে পাঁচ আক্রমণকারী ছাড়াও নয় ইতালীয়, সাত জাপানি এবং এক ভারতীয়সহ মোট ২৭ জন নিহত হয়েছিলেন। এটিকে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ‘সন্ত্রাসবাদী’ ঘটনা হিসেবে মনে করা হয়।

আপত্তি অস্বস্তিকরউপাদানে

সেন্সর বোর্ডের সদস্য নওশাদ বলেন, “দেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত হলে ভালো মানের নির্মাণও সরকার আটকে দিতে পারে। এর আগেও অনেক বড় নির্মাতার সিনেমা একই কারণে আটকে গিয়েছে।”

“এর আগে রানা প্লাজার ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত একটি চলচ্চিত্রও আমরা (সেন্সর বোর্ড) একই কারণে আটকে দিয়েছিলাম,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ওই ঘটনা আমাদের দেশের পর্যটন ও বাণিজ্যিক খাতের জন্য স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে এসেছিল।”

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যু এবং ১৭ দিন ধরে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া পোশাক শ্রমিক রেশমাকে উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে তৈরি ‘রানা প্লাজা’ চলচ্চিত্রের পরিচালক নজরুল ইসলাম খান সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েও সিনেমাটি মুক্তি দিতে পারেননি।

সেন্সর বোর্ডের আরেক সদস্য গুলজার বলেন, “আমার বলেছিলাম ‘শনিবার বিকেল’ একটি ভালো সিনেমা, পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর নির্মাণ।”

“তবে সরকারের প্রতিনিধিরা যদি অনুভব করেন যে এটি বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে বা সিনেমাটির কারণে অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে, সে ক্ষেত্রে আমাদের কিছুই করার থাকে না,” যোগ করেন এই পরিচালক।

এ ব্যাপারে নির্মাতা ফারুকী মনে করেন, “চলচ্চিত্রটি আটকে দেওয়ার ঘটনাই বরং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে।”

ফারুকীর ছবি আন্তর্জাতিক মানের

‘শনিবার বিকেল’ সিনেমাটির মুক্তি আটকে যাওয়ায় ‘হতাশ’ ফাহমিদুল আরও বলেন, “এর ফলে দেশের মানুষের সিনেমাটি দেখার সুযোগ কমে যাবে। তবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বা চলচ্চিত্র উৎসবগুলোয় এর প্রদর্শনী কিন্তু সরকার ঠেকাতে পারবে না।”

যদিও প্রদর্শক সমিতির নেতা নওশাদের অভিমত, “যেহেতু সিনেমাটি বাংলাদেশের একটি ‘স্পর্শকাতর’ ও ‘আবেগঘন’ ঘটনাকে উপজীব্য করে নির্মিত, সেহেতু এ দেশের সরকারকে অগ্রাহ্য করে কোথাও ছবিটি মুক্তি দেওয়া উচিত হবে না।”

ফারুকীর অধিকাংশ সিনেমা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোকে লক্ষ্য করে নির্মাণ করা হয় বলেও দাবি করেন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মধুমিতা সিনেমা হলের এই মালিক।

বাংলাদেশের জাজ মাল্টিমিডিয়ার পাশাপাশি জার্মানি ও ভারতের দুটি প্রযোজনা সংস্থা ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমায় বিনিয়োগ করেছে। এতে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের জাহিদ হাসান, নুসরাত ইমরোজ তিশা, ইরেশ যাকের, মামুনুর রশীদ, ফিলিস্তিনের অভিনেতা ইয়াদ হুরানি, ভারতের কলকাতার পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।

আর্টিজান মালিকের সাক্ষ্য প্রদান

হলি আর্টিজান হামলার মামলায় বুধবার আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন বেকারিটির মালিক সাদাত মেহেদী। ঘটনা বর্ণনাকালে তিনি বলেন, “সেদিন যুদ্ধের মতো শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর পর গুলি হচ্ছিল। দুটো শক্তিশালী বোমা ফাটে। তখনও ভেতরে গোলাগুলি চলছে।”

সাদাত মেহেদীর স্ত্রী সামিরা আহমেদ, হলি আর্টিজান বেকারির শেফ আকাশ খান এবং আব্দুল হাকিমও এই দিনে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আগামী ২৯ জানুয়ারি পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ঠিক করেছেন ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবর রহমান।

সংশোধনী: মূল প্রতিবেদনে সেন্সর বোর্ডের সদস্যদের বরাত দিয়ে ৯ জানুয়ারি সিনেমাটি আটকে দেবার কথা বলা হয়েছিল, যা তথ্যগতভাবে ভুল থাকায় সংশোধন করা হলো।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।