কলকাতায় উদযাপিত হচ্ছে বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ

পরিতোষ পাল
2018.11.09
কলকাতা
181109_WB_Story_1000.jpg কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন, পরিচালক গৌতম ঘোষ প্রমুখ। ৩ নভেম্বর ২০১৮।
[বেনারনিউজ]

বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ উদযাপিত হচ্ছে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এই উৎসবটি শনিবার থেকে শুরু হয়ে চলবে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত।

বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ উপলক্ষে এবারের উৎসবে নানা আয়োজন রাখা হয়েছে।

“উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রকাশ করা হচ্ছে শতবর্ষের বাংলা চলচ্চিত্রপঞ্জি। ১৯১৭ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তৈরি হওয়া চলচ্চিত্রের বিস্তারিত তথ্য এই সংকলনে রয়েছে”, বলেন উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়।

গত ৩ নভেম্বর উৎসবের ২৪তম সংস্করণের লোগো প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলা চলচিত্রের শতবর্ষ উপলক্ষে এবারের উৎসবে প্রদর্শনী, শতবর্ষের আড্ডাসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। মঞ্চস্থ হবে প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা হীরালাল সেনের উপর তৈরি নাটক ‘হীরালালের বায়োস্কোপ’।”

উৎসব কমিটি সূত্রে বলা হয়, এবারের উৎসবে দেখানো হবে ১৪টি কালজয়ী বাংলা চলচ্চিত্র। এগুলো হলো: বিমল রায়ের ‘উদয়ের পথে’, প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’, মধু বোসের ‘আলিবাবা’, অসিত সেনের ‘উত্তর ফাল্গুনি’, সলিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘স্ত্রীর পত্র’, উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ‘চোখ’, অজয় করের ‘সপ্তপদী’, গৌতম ঘোষের ‘পদ্মানদীর মাঝি’, সরোজ দের ‘কোণি’, তপন সিংহের ‘কাবুলিওয়ালা’, রাজেন তরফদারের ‘গঙ্গা’, তরুণ মজুমদারের ‘গণদেবতা’ ও ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উনিশে এপ্রিল’।

কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালক থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র প্রেমীরা।

কলকাতা উৎসবে ৭০টি দেশের চলচ্চিত্র

“বাংলা ছবিসহ কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আট দিনে ১৬টি প্রেক্ষাগৃহে ৭০টি দেশের ৩২১টি চলচ্চিত্র দেখানো হবে। এর মধ্যে ১৭১টি পূর্ণ দৈর্ঘ্য, ১৫০টি স্বল্প দৈর্ঘ্য ও ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র,” বলেন উৎসবের ডিরেক্টর মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে শ্রেষ্ঠ ছবিকে দেওয়া হবে ৫১ লক্ষ রুপি, আর শ্রেষ্ঠ পরিচালক পাবেন ২১ লক্ষ রুপি। সেই সঙ্গে বেঙ্গল গোল্ডেন টাইগার ট্রফি। বিশেষ হীরালাল মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড বিভাগে ভারতীয় ভাষার শ্রেষ্ঠ ছবি পাবে ৭ লক্ষ রুপি এবং সেরা পরিচালক পাবেন ৫ লক্ষ রুপি।”

১৯৯৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের সূচনা হয়। পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্টারন্যাশানাল ফেডারেশন অব ফিল্ম প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (ফিয়াপ) কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবকে আন্তর্জাতিক উৎসবের তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করে।

কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরের মতো এবারও চলচ্চিত্র প্রেমীদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেছে। ডেলিগেট হওয়ার জন্য কয়েক হাজার আবেদন জমা পড়ে।

শুক্রবার নন্দন প্রাঙ্গনে ডেলিগেট কার্ড সংগ্রহ করে বেরিয়ে আসা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্রী রঞ্জনা সেন বেনারকে বলেন, “সারা পৃথিবীর ছবি দেখার সুযোগ পাই এই উৎসবে। আর তাই প্রতিবছর অপেক্ষায় থাকি। এবার তো অতিরিক্ত পাওনা পুরোনো দিনের হারিয়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি ছবি।”

বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ

বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ বেনারকে বলেন, “কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন নিঃসন্দেহে সাধু উদ্যোগ।”

“বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ নিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। তবে একে চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে,” মনে করেন তিনি।

কলকাতায় তৈরি রুস্তমজি ধোতিওয়ালা পরিচালিত ‘সত্যবাদী রাজা হরিশচন্দ্র’ নামের নির্বাক চলচ্চিত্রটিকে প্রথম বাংলা ছবি ধরে শতবর্ষ উদযাপন চলছে। ১৯১৭ সালের ২৪ মার্চ কলকাতা ময়দানে তাঁবু তৈরি করে এটি দেখানো হয়েছিল। চলচ্চিত্রটিতে বাংলা ইনটার টাইটেল ছিল।

চলচ্চিত্রের ঐতিহাসিকদের মতে, ভারতে নির্বাক যুগের চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত। এরপর ১৯৩১ সাল থেকে সবাক চলচ্চিত্রের সূচনা হয়েছে। সেই সময়ই প্রথম বাংলা সবাক ছবি ‘জামাই ষষ্টি’ তৈরি হয়েছিল।

পরিচালক গৌতম ঘোষ বলেন, “নির্বাক যুগের তো বটেই, সবাক যুগেরও অধিকাংশ ছবি অবহেলায় শতবর্ষের ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছে। তাই হারিয়ে যাওয়া চলচ্চিত্রকে উদ্ধার করার পাশাপাশি চলচ্চিত্র সংরক্ষণের বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে ভাবা দরকার। দুই বাংলাতেই পুরনো চলচ্চিত্রের সংরক্ষণের উপরে জোর দেওয়া উচিত।”

শতবর্ষ নিয়ে বিতর্ক

বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ নিয়ে বিতর্কও তৈরি হয়েছে। চলচ্চিত্র গবেষকদের মতে, অভিভক্ত ভারতের অধুনা বাংলাদেশের মানিকগঞ্জের যুবক হীরালাল সেনই ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা।

১৮৯৮ সালেই তিনি কলকাতার স্টার থিয়েটারে মঞ্চস্থ একটি নাটক থেকে নাচের দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন। এরপরে তিনি আরও এই ধরনের চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপন চিত্র তৈরি করেছিলেন।

দুর্ভাগ্যবশত, ১৯১৭ সালে তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক ভয়ঙ্কর আগুনে হীরালাল সেনের সব চলচ্চিত্রই নিঃশেষ হয়ে যায়।

চলচ্চিত্র আলোচক অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় হীরালাল সেনকে বাদ দিয়ে বাংলা শতবর্ষের ইতিহাস চর্চ্চার তীব্র সমালোচনা করে বেনারকে বলেন, “এই ধরনের উদ্যোগকে মেনে নেওয়া যায় না।”

তিনি বলেন, “১৯১৭ সালের আগেই কলকাতায় চলচ্চিত্র তৈরির ক্ষেত্রে হীরালাল সেন অনেকগুলি ধাপ পেরিয়ে এসেছিলেন।”

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অঞ্জন বেরা বেনারকে বলেন, “হীরালাল সেনের অবদানকে বাদ দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ উদযাপন করা অর্থহীন।”

তিনি বলেন, “হীরালাল সেনই প্রথম রাজনৈতিক ছবি তৈরিরও সূচনা করেন। ১৯০৫ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গবিরোধী বিক্ষোভ ও স্বদেশি আন্দোলন নিয়ে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন।”

তাঁর মতে, “বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষের ইতিহাস লেখার কাজটি দুই বাংলার চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে করতে পারলে তবেই সেটি সঠিক ও সম্পূর্ণ হবে।”

পরিচালক গৌতম ঘোষ বলেন, “এটা ঠিক যে, চলচ্চিত্র চর্চ্চার ক্ষেত্রে হীরালাল সেনকে উপেক্ষাই করা হয়েছে। আসলে বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি। তাই বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ নিয়ে বিতর্ক হওয়া স্বাভাবিক।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।