বাংলাদেশে এক বছরে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ৬৫ শতাংশ
2024.02.20
ঢাকা
বাংলাদেশের আর্থিক খাতে গত কয়েক বছর ধরে নানা অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ উঠছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্য বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে গত বছর দেশে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছিল ৬৫ শতাংশ।
অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন রোধে কাজ করা এই সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, “২০২৩ সালে আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্ট (এসটিআর) ও সন্দেহজনক কার্যক্রমের রিপোর্টের (এসএআর) সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। এর আগের বছরে যা ছিল প্রায় সাড়ে আট হাজার।”
বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস মঙ্গলবার রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যালয়ে প্রতিবেদনটির বিষয়বস্তু তুলে ধরে সাংবাদিকদের বলেন, “ব্যাংক, নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।”
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত চার বছরে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে পাঁচ গুণ। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা এই তথ্যের সঙ্গে আর্থিক খাতে অপরাধ ও দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার মিল খুঁজছেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান, অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “গত কয়েক বছর ধরে দেশের আর্থিক খাতে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ও জালিয়াতির কথা শোনা যাচ্ছিল। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে তার প্রমাণ মিলেছে।”
তিনি বলেন, “এক বছরে সন্দেহজনক লেনদেনের প্রতিবেদন দুই-তৃতীয়াংশ বেড়ে যাওয়া আর্থিক খাতে অনিয়ম ও অপরাধ বাড়ার ইঙ্গিত দেয়।”
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. এম মাশুরুর রিয়াজ বলেন, “নির্বাচনের আগের প্রচুর নগদ লেনদেনের প্রবণতা থাকে। এটিও একটি কারণ হতে পারে।”
যদিও বিএফআইইউর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সন্দেহজনক সব লেনদেন (এসটিআর) অপরাধ নয়।
গত এক দশকে দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়েছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। এছাড়া, আর্থিক খাতে বড় বড় কেলেঙ্কারির ঘটনাও সামনে এসেছে।
মাত্র তিন সপ্তাহ আগে বার্লিনভিত্তিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে এসেছে, দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের দুই ধাপ অবনতি হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন অঙ্গীকার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার ঘোষণা বাস্তবিক অর্থে প্রয়োগ হয়নি।”
তিনি মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে বিএফআইইউর নজরদারি যে জোরালো হয়েছে, তা এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে বোঝা যায়।”
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে পাস হওয়া অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনে সন্দেহজনক লেনদেনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যাহা স্বাভাবিক এবং সাধারণ লেনদেনের ধরন হতে ভিন্ন বা যে লেনদেন অপরাধ হতে অর্জিত সম্পদ বা কোনো সন্ত্রাসী কার্যে, কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনকে বা সন্ত্রাসীকে অর্থায়ন করে, এমন লেনদেন।
বিএফআইইউর নির্দেশিকায় কী ধরনের লেনদেন সন্দেহজনক হিসেবে বিবেচিত হবে তাও বলা হয়েছে; জটিল বা অস্বাভাবিক বড় আকারের লেনদেন, যার সঙ্গে দৃশ্যমান অর্থনৈতিক বা আইনি উদ্দেশ্য দেখা যায় না, দেশের বাইরের কোনো গ্রাহকের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় ও অস্বাভাবিক লেনদেন, গ্রাহকের ব্যবসায়িক সম্পর্কের বিবেচনায় পণ্য, সেবা বা ভূ-খণ্ডে ঝুঁকিপূর্ণ লেনদেন সন্দেহজনক হিসেবে বিবেচিত হবে।
এছাড়া এমন লেনদেন গ্রাহক বা ব্যবসায়িক সম্পর্ক; যা অর্থ পাচার বা সন্ত্রাসে অর্থায়নের মতো সন্দেহ সৃষ্টি করে, তাও এর আওতায় আসবে।
ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে নিয়মিত বিএফআইইউকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
বাংলাদেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, তার বিশ্বাসযোগ্য কোনো পরিসংখ্যান বা তথ্য নেই।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি গত বছরের মে মাসে বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরার সময় বলেছিল, ৫০ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সে হিসাবে গড় বছরে অন্তত ২৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
সন্দেহজনক লেনদেনের ৯০% ব্যাংকের মাধ্যমে
বিএফআইইউর প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, গত বছর সন্দেহজনক লেনদেনের যে তথ্য পাওয়া গেছে, তার ৯০ শতাংশ এসেছে ব্যাংক খাত থেকে। তালিকায় এর পরে রয়েছে প্রবাসী আয় আনার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠান (যেমন এক্সচেঞ্জ হাউস), ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট পক্ষ ও অন্যান্য।
জুয়া, অনলাইনে জালিয়াতি, ক্রিপ্টো বা ডিজিটাল মুদ্রা ও ডিজিটাল হুন্ডি সন্দেহজনক লেনদেন বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
মাসুদ বলেন, “আমাদের অর্থ পাচার প্রতিরোধে মনোযোগ বেশি। যদি আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে অনিয়ম না হয়, মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি-রপ্তানি ও হুন্ডি না করা যায়, তাহলে অর্থ পাচার এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।”
তিনি বলেন, “আমরা একবার সিঙ্গাপুর থেকে পাচার হওয়া টাকা ফেরত এনেছিলাম।”
পাচার হওয়া অর্থ আনতে ১০টি দেশের সঙ্গে চুক্তি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে এ ধরনের লেনদেন বাড়তেই থাকবে’
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, সন্দেহজনক লেনদেনসহ আর্থিক খাতের অনিয়ম ঠেকাতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, “সন্দেহজনক লেনদেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা দেখার বিষয়। কেননা আইনের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া না হলে জড়িতদের সাহস আরও বেড়ে যাবে। অন্যরাও একই কাজ করতে উৎসাহিত হবেন।
“তখন মনে হবে, এত আনুষ্ঠানিকতা করে তথ্য প্রকাশ করার পরও কিছু হয়নি, অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা নেই,” মত দেন তিনি।
ড. জাহিদ বলেন, বিএফআইইউ অন্ততপক্ষে রিপোর্ট প্রকাশ করতে পারছে বা এই সংখ্যা যে বাড়ছে সেটি বলতে পারছে—সেটিও সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, “ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন, গোয়েন্দা সংস্থা, কাস্টমস বিভাগসহ অন্য পক্ষগুলোরও করণীয় আছে। তারা কী পদক্ষেপ নেয়, এখন সেটি দেখার বিষয়।”
সন্দেহজনক লেনদেন তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি না, জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বেনারকে কোনো তথ্য জানাতে পারেননি।