সুন্দরবনে আগুন নিভেছে: মৌয়াল, বাওয়াল ও জেলেদের ঘিরে সন্দেহ
2024.05.06
ঢাকা
ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবনে গত শনিবার থেকে শুরু হওয়া আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও এর উৎস নিয়ে নানামুখী বক্তব্য পাওয়া গেছে।
প্রাথমিকভাবে বন বিভাগ ও বন সংশ্লিষ্টদের সন্দেহ হচ্ছে, সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মৌয়াল, বাওয়াল ও জেলেদের মাধ্যমে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।
এমনকি বনজীবী ব্যক্তিদের বিড়ি-সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অথবা তাঁদের ব্যবহৃত আগুনের ফুলকি থেকেও আগুন লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যদিও অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদঘাটনে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বন বিভাগ।
গত শনিবার দুপুরে দক্ষিণের জেলা বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের আওতাধীন চাঁদপাই রেঞ্জের আমরবুনিয়া ক্যাম্পে আগুন লাগে। বন বিভাগ ছাড়াও দমকল বাহিনী, কোস্টগার্ড ও বাংলাদেশ নৌ বাহিনী এই আগুন নেভাতে কাজ করে যাচ্ছে।
সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন মোড়েলগঞ্জ দমকল বাহিনীর সহকারি উপপরিচালক সাইদুল আলম চৌধুরী।
বেনারকে তিনি বলেন, প্রায় আড়া্ই কিলোমিটার জুড়ে এই আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল এবং আগুন পুরোপুরি নিভতে আরও দুই একদিন লেগে যাবে।
যদিও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সোমবার বিকেলে জানানো হয়, “বিভিন্ন গণমাধ্যমে বর্গকিলোমিটার এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে অগ্নিকাণ্ডের ব্যপ্তি ছিল ৭ দশমিক ৯ একর, যার মধ্যে ৫ একর এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে গত কয়েক দিন ধরে সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে দুই থেকে আড়াই কিলোমিটারজুড়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ার খবর প্রকাশিত হয়।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম সোমবার দুপুর তিনটায় বেনারকে বলেন, “সুন্দরবনের অগ্নিকাণ্ডের কারণ বের করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে আমাদের ধারণা সুন্দরবনে যারা মধু ও কাঠ সংগ্রহ করতে এবং মাছ শিকারে যান তাদের অসাবধানতায় আগুন লাগতে পারে।”
তিনি বলেন, “হয়তো তাদের কেউ সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা ফেলে দিয়েছে এবং সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহের কারণেও সেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
নুরুল করিম বলেন, “আগুন নিয়ন্ত্রণ আনা গেছে-এটা বলা যায়। তবে পুরোপুরি নিভে গেছে-এটা বলা কঠিন। আমরা ড্রোন দিয়ে দেখছি, কোথায় আগুন জ্বলছে। আগুন পুরোপুরি নিভতে আরও দুই-একদিন সময় লাগতে পারে।”
তিনি বলেন, “শুধু বনবিভাগ নয়। দমকল বাহিনী, কোস্ট গার্ড, বাংলাদেশে নৌ বাহিনী এবং স্থানীয় বাসিন্দারা আগুন নেভানোর কাজ করছে। স্থানীয় জনগণ বনাঞ্চল ভালোভাবে চেনে। তাদের সহায়তা ছাড়া আগুন নেভানো কঠিন।”
নূরুল করিম বলেন, “সুন্দরবনের আগুন অন্যান্য বনের আগুনের চেয়ে আলাদা। যেখানে আগুন লেগেছে, সেখানে গাছের গোড়ায় শুকনা পাতা ও ডালপালার স্তুপ রয়েছে। এ ছাড়াও গাছের গোড়ায় পাতা পচে দাহ্য মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়েছে। সেকারণে আগুন ওপর দিকে না উঠে গোড়ার দিকে প্রসারিত হচ্ছে।”
সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমদ বেনারকে বলেন, সুন্দরবনে প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে চাঁদপাই রেঞ্জের দিকে আগুনের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে।
তিনি বলেন, “সুন্দরবনের মাটি সবসময় ভেজা থাকে। সেকারণে ওখানে আগুন ধরার সম্ভাবনা খুব কম। তবে আগুন যেখানে লাগে সেই চাঁদপাই রেঞ্জ কিছুটা উঁচু। সেখানে বেশ কয়েকটি খাল পলিমাটিতে ভরাট হয়ে গেছে।”
অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে ইশতিয়াক উদ্দিন বলেন, “তদন্ত ছাড়া সুনির্দিষ্ট কারণ বলা সম্ভব নয়। তবে আমি চাকুরিতে থাকাকালীন দেখেছি, মৌয়ালরা আগুন দিয়ে মৌমাছির চাক থেকে মধু সংগ্রহ করেন। আবার অনেকে বিড়ি-সিগারেট টেনে আগুন না নিভিয়ে ফেলে দেয়। সেই আগুন থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “সুন্দরবনের জেলেরা সাধারণত নৌকায় রান্না করেন। কিন্তু সুযোগ পেলে নৌকার পরিবর্তে বনের মাটিতে নেমেও রান্না করেন। অনেক সময় তারা আগুন না নিভিয়ে চলে যান। সেই আগুন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।”
ইশতিয়াক উদ্দিন বলেন, “আবার জেলেরা নলখাগড়া সংগ্রহের পর সেখানে আগুন লাগিয়ে দেয়। পোড়া নলখাগডার ছাই খেতে সেখানে মাছ আসে। তখন জেলেরা জাল পেতে সহজে মাছ ধরতে পারে।”
এই আগুনের কারণে জীববৈচিত্র্য যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে-সে বিষয়ে সন্দেহ নেই বলে জানান তিনি। তবে কতটুকু হবে-সেটি জানা যাবে আগুন পুরোপুরি নিভে যাওয়ার পর।
জীববৈচিত্র্য ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা
সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের পূর্ব আমবুনিয়া গ্রামের বনজীবী সম্প্রদায়ের নেতা ও ভিলেজ কনজারভেশন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মহিদুল ইসলাম সোমবার দুপুরে বেনারকে বলেন, “আগুন শতকরা ৮০ ভাগ নিয়ন্ত্রণে বলা যায়। নৌ বাহিনী ড্রোন দিয়ে দেখছে কোথাও ধোঁয়া উঠছে কি না। যেখানে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে সেখানেই আমরা যাচ্ছি।”
মহিদুল ইসলামসহ পূর্ব আমরবুনিয়া গ্রামের সাধারণ মানুষ দমকল বাহিনী, বন বিভাগ ও নৌবাহিনীর সাথে আগুন নেভাতে কাজ করছেন।
মহিদুল বলেন, “আজকে ড্রোন দিয়ে দেখা গেছে, দুটি স্থান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ”
কতটুকু এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়েছে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “লম্বালম্বি যদি বলা হয় তাহলে বলবো, তিন কিলোমিটার পর্যন্ত আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। তবে আগুন গাছের উপর দিকে উঠেছে না। গাছের গোড়ার দিকে ছড়াচ্ছে।”
আগুনে বাঘ অথবা অন্যান্য পশুপাখির ক্ষয়ক্ষতি কেমন হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে মহিদুল বলেন, বাঘসহ যেসব পশু-পাখি মাটির উপর দিকে অবস্থান করে সেগুলো পালিয়ে অন্যত্র চলে গেছে।
তিনি বলেন, “তবে মাটির নীচে থাকে এমন প্রাণীগুলো বাঁচবে না।”
উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, “সজারু, উদবিড়াল, সাপ এগুলো মারা যাবে। এগুলো গর্ত থেকে বেরিয়ে বাঁচবে না।”
মহিদুল বলেন, “পুরো অঞ্চলের গাছগুলো কিছুদিন পর ভেঙ্গে পড়বে অথবা জোয়ার আসলে উপড়ে যাবে।”
বনজীবী মানুষদের কারণে আগুন লেগেছে-এমন ধারণার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন তিনি।
মহিদুল বলেন, “আগে বনজীবী মানুষরা আগে অসচেতন ছিল। বিড়ি-সিগারেট যেখানে-সেখানে ফেলে দিত। কিন্তু তারা এখন এটা করে না। তারা বোঝে যে, বন ধ্বংস হলে তাদের জীবন বিপন্ন হবে।”
এদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, আগামী কয়েকদিন অগ্নি নির্বাপন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম চলমান রাখা হবে।
এতে বলা হয়, ফরেস্ট ফায়ার আপাতত নিভে গেছে বা নিয়ন্ত্রণ হয়েছে মনে হলেও আবার যে কোন সময় এটি নতুনভাবে সৃষ্টি ও বিস্তৃতি লাভ করতে পারে।
মার্কিন সরকারের অর্থায়নে বাংলাদেশ পরিচালিত আরণ্যক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রকিবুল হাসান মুকুল বেনারকে বলেন, সুন্দরবনে প্রায়ই আগুনের ঘটনা ঘটে। আগুন লাগলে সেখানে তো গাছপালা এবং পশুপাখি মারা যায়। তাদের বাসস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মোটা দাগে বলা যায়, আগুনে জীববৈচিত্র্যের কিছুটা ক্ষতি হয়।”
তিনি বলেন, “তবে এই আগুন খুব বেশি ক্ষতি করবে বলে মনে হয় না। এর কারণ হলো সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অসংখ্য ছোট-বড় খাল, নালা এবং নদী রয়েছে যেগুলো প্রাকৃতিক একটি সুরক্ষা দেয়।”
বন গবেষক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, সরকারি হিসাবে সুন্দরবনে ২০০২ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে সেসব ঘটনা থেকে বনবিভাগ কতটুকু শিক্ষা নিয়েছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।
বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে অবস্থিত বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। এই বনে বিপন্ন প্রাণী ও বাংলাদেশ এবং ভারতের জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বসবাস। এছাড়াও শত শত প্রাণীকুলের বসবাস এই সুন্দরবনে।
১৯৯৭ সাল থেকে সুন্দরবন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য।