করোনা মহামারির সময়ে বন্যায় বড় সংকটে মানুষ
2020.07.15
ঢাকা
চলমান করোনাভাইরাস সংকটের মধ্যেই বন্যায় ডুবে গেছে দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ এলাকা, আক্রান্ত ২১টি জেলা। উজানি ঢলে নদনদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করায় ভেসে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি, রাস্তাঘাট ও হাটবাজার। পানি ধেয়ে আসছে রাজধানী ঢাকার দিকেও।
“ঢাকার কিছু অঞ্চলে পানি ঢুকেছে এবং আগামী ৭২ ঘন্টায় রাজধানীর অনেক নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে,” বেনারকে বলেন বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া।
ঢাকার কয়েকটি এলাকায় পাম্প বসিয়ে পানি সরানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এ বছর জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে দেশের নদীতীরবর্তী ও নিম্নাঞ্চলগুলোতে প্রথম দফা বন্যা দেখা দেয়। সেই পানি নামতে না নামতেই গত এক সপ্তাহে আবার তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, এবার বন্যা ২৩ জেলায় বিস্তৃতি লাভ করবে এবং তা আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত থাকবে। এত লম্বা সময় যাবত বন্যা অতীতে কখনও হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
১৯৯৮ সালে বন্যায় দেশের ৬৩ শতাংশ এলাকা ডুবে গিয়েছিল, যার স্থায়িত্ব ছিল ১৭ দিন। ১৯৮৮ সালের বন্যায় ৬৭ শতাংশ ও ২০০৭-এর বন্যায় ৫৩ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। এবার আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের ৪০ শতাংশ এলাকা ডুবে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ভারতের মেঘালয়, চেরাপুঞ্জি, আসাম ও ত্রিপুরা এবং চীন ও নেপালের পানি ভাটির দিকে নেমে আসায় বাংলাদেশে এই বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি যে পর্যায়ে, তাতে ১৯৯৮ সালের ৩৩ দিনের বন্যার রেকর্ড ছুঁয়ে যেতে পারে চলমান বন্যা।
ইতিমধ্যে ৩ লাখ পরিবারের সাড়ে ১৪ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান।
“বেশি বন্যাকবলিত এলাকায় এক হাজার ৩৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের রান্না করা খাবার দিতে সেইসব জেলার ডিসিদের ৫ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে,” মঙ্গলবার বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান।
যত বড় দুর্যোগ আসুক এবং তা যতই দীর্ঘস্থায়ী হোক না কেন, সরকারের ত্রাণসহায়তা চালিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষমতা রয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।
গত মার্চ থেকে করোনা দুর্যোগ মোকাবেলা করছে সরকার। সংকট মোকাবেলায় বিভিন্ন খাতে এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা, বেকার হয়ে পড়া লাখ লাখ পরিবার ও সাড়ে ৩ কোটি মানুষকে নগদ সহায়তা দিয়েছে সরকার।
চারদিকে থৈ থৈ পানি
“যমুনার পানি অস্বাভাবিক বেড়ে লোকালয়ে চলে এসেছে। পানিতে থৈ থৈ করছে আমাদের এলাকা। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকেই উঁচু স্থানের দিকে ছুটছেন,” বেনারকে জানান জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার বেলগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক।
ওই জেলার ৬ উপজেলার ৫০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। একই দৃশ্য টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, কুড়িগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে। বন্যা কবলিত এলাকায় পানিবন্দি হয়ে আছেন হাজার হাজার মানুষ।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে নীলফামারী, লালমনিরহাট, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নাটোর, রাজবাড়ী, ঢাকা, ফেনী, নওগাঁ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও দিনাজপুর জেলায় বন্যা চলছে।
ঢাকার নিকটবর্তী নবাবগঞ্জ, দোহার ও মানিকগঞ্জের নিম্নাঞ্চলও এখন পানির নিচে।
দেশের সকল নদনদীর পানি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ফলে বাড়ছে বন্যার পরিসর। এর প্রভাবে বুধবার বিকেল পর্যন্ত অন্তত ২১টি জেলার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে।
এদিকে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের উজানে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গে গতকালও ভারি বৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিদিনই ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টি আগামী দু-তিন দিন অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র। এর ফলে আগামী তিন-চার দিন উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
সংকটে মানুষ
মহামারি করোনায় বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে দেশ। এর মধ্যে ২১ জুন ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাত বড় ক্ষতি করে গেছে। এ পর্যায়ে বন্যার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতিতে তৈরি হয়েছে বাড়তি চাপ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কৃষকের ৪৯৭ কোটি টাকার ফসল কেড়ে নিয়েছে এই বন্যা।
“বিভিন্ন জেলায় অন্তত ৪৩ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৫০০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে,” বেনারকে জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মুঈদ।
এছাড়া নলকূপ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কোনো কোনো এলাকায় তীব্র পানিসংকট দেখা দিয়েছে। গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে আছেন বানভাসী কৃষকরা।
“সুনামগঞ্জে প্রথম দফা বন্যা দেখা দেয় গত ২৫ জুন। গোটা জেলা তখন কমবেশি বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। ওই বন্যার পানি নামতে না নামতেই ১০ জুলাই থেকে আবার জেলায় দ্বিতীয় দফা বন্যা শুরু হয়। এখনো পুরো জেলা বন্যাকবলিত এবং পানি বাড়ছে,” বেনারকে বলেন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নদীভাঙন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “প্রথম দফা বন্যায় শতাধিক মৎস্য খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। তাঁদের ঘেরের কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। অধিকাংশ খামারিই আবার ঘেরে মাছের পোনা ছেড়েছেন। কিন্তু সপ্তাহ না যেতেই দ্বিতীয় দফা বন্যায় সবকিছু ভেসে গেছে।”
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ইলিয়াছ আলী বেনারকে বলেন, “আমার এলাকায় অনেক মানুষ ধরলা নদীর ভাঙনে ফতুর হয়ে গেছে। যেভাবে নদী ভাঙছে তাতে এবার মূল বাঁধ ভাঙে নাকি সেটাই সন্দেহ।”