আরো মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি

কামরান রেজা চৌধুরী
2017.08.14
ঢাকা
জামালপুরে পানিবন্দী মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। জামালপুরে পানিবন্দী মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। আগস্ট ১৪, ২০১৭।
ফোকাস বাংলা

ভারী বর্ষণ আর উজানের ঢলে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের কমপক্ষে ২০টি জেলা মারাত্মকভাবে বন্যা আক্রান্ত হলেও আগামী সপ্তাহে দেশের বন্যা পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সর্তকীকরণ কেন্দ্র।

গত দুইদিনে (রোববার-সোমবার) উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় তিন জেলায় শিশুসহ কমপক্ষে ২৪ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ দিনাজপুরে মারা গেছেন ১৪ জন।

ভারত, ভুটান ও নেপালে ভারী বর্ষণের ফলে ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, মেঘনাসহ দেশের নদ-নদীগুলোতে প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই বন্যা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। এ বন্যা মোকাবিলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে বলে দাবিও করছে সরকার। ইতিমধ্যে বন্যার্তদের সহায়তায় কয়েকটি জেলায় সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে।

আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম শাম্মী বেনারকে জানান, “ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি বন্যা কবলিত জেলায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ পুনঃনির্মাণসহ বন্যার্তদের সহায়তায় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।”

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য মতে ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, মেঘনা, ধরলা, দুধকুমার, তিস্তার পানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় দেশের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বেরসহ কমপক্ষে ২০টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে।

চলতি মৌসুমের দ্বিতীয় দফার এ বন্যায় এখন পর্যন্ত পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার ৩৯০ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। ৯৭৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে আক্রান্ত তিন লাখ ৬৮ হাজার ৫৮৬ জন মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলো হলো: নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁ, দিনাজপুর, নওগাঁ, নাটোর, রাজশাহী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী, জামালপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও গাজীপুর।

“বন্যায় দিনাজপুর ও লালমনিরহাট জেলার অনেক অংশে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে কারণে, ঢাকা থেকে দিনাজপুর ট্রেন সাময়িকভাবে বন্ধ আছে। ঢাকা থেকে লালমনিরহাট পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করছে। তবে লালমনিরহাট থেকে বুড়িমারী সীমান্ত পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ রেখেছি," বেনারকে বলেন রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হাবিবুর রহমান।

দিনাজপুর জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. গোলাম রাব্বী সোমবার বেনারকে বলেন, গত দুদিনের (রবিবার-সোমবার) বন্যায় দিনাজপুরে এখন পর্যন্ত ১৪ জন মানুষ মারা গেছে। মৃতদের অধিকাংশই শিশু।

“আমরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা ভবনে আশ্রয়কেন্দ্র খুলে সেখানে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের খাবার পরিবেশন করছি,” বেনারকে বলেন গোলাম রাব্বী।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান সোমবার বেনারকে বলেন, “বন্যায় গত দুই দিনে দুই শিশুসহ ছয়জন প্রাণ হারিয়েছেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলার নয়টি উপজেলার কমপক্ষে ১৪ হাজার পরিবার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।”

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ সোমবার বেনারকে বলেন, “গত দুই দিনে একজন শিশুসহ মোট চারজন মানুষ বন্যায় মারা গেছে। আর এই জেলায় এক লক্ষ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”

কুড়িগ্রামে চোখের সামনে পানির তোড়ে ভেসে যাচ্ছে চলাচলের সড়ক। আগস্ট ১৪, ২০১৭।
কুড়িগ্রামে চোখের সামনে পানির তোড়ে ভেসে যাচ্ছে চলাচলের সড়ক। আগস্ট ১৪, ২০১৭।
ফোকাস বাংলা

ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা

বন্যা পূর্বাভাস ও সর্তকীকরণ কেন্দ্রের সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল হোসেন বেনারকে বলেন, “পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৯০টি প্রবাহ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যে প্রায় ৭০টিতে প্রবাহ বেড়েছে। আর ২৭টি পয়েন্টে প্রবাহ বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।”

উজানে (ভারতে) বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে আরো অনেক জেলা বন্যায় প্লাবিত হতে পারে এবং আগামী সপ্তাহে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।

বন্যা ব্যবস্থাপনা ও পানি বিশারদ ড. আইনুন নিশাত বেনারকে বলেন, “উজানের দেশ ভারত, ভুটান, নেপালের বৃষ্টিপাত না কমলে গঙ্গার পানি বৃদ্ধি পাবে এবং এর ফলে আগামী ১৮ বা ১৯ আগস্টে মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ও ঢাকা জেলায় বন্যা দেখা দিতে পারে। আর এটা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক বন্যা হতে পারে। সেভাবেই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।”

দুর্যোগমন্ত্রী বলেন, “মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। প্রয়োজন অনুযায়ী চাহিদা মেটানো হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এ ব্যবস্থা চলবে।”

দেশে পর্যাপ্ত খাবার মজুত রয়েছে বলেও জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, গত কয়েক দশকে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়। এতে দেশের ৬৮ শতাংশ এলাকা বন্যা আক্রান্ত হয়েছিল। এ ছাড়া ১৯৮৮ সালের ৬১ শতাংশ, ২০০৭ সালে ৪০ শতাংশের বেশি, ২০১৩ সালে মাত্র ১০ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়।

ভারত ও নেপাল পরিস্থিতি

ভারতের আসাম রাজ্য সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ বুলেটিন মতে বন্যায় এখন পর্যন্ত রাজ্যে ৯০ জন নিহত ও ১৯টি জেলার প্রায় ২২ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়েছেন।

“ব্রহ্মপুত্র এবং এর শাখা নদীগুলো ৩ হাজার ২০০ গ্রাম প্লাবিত ও ২২ লাখ লোককে গৃহহারা করে বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পরবর্তী দুই দিনের সম্ভাব্য টানা বৃষ্টিতে পরিস্থিতর আরো অবনতি ঘটতে পারে,” জানায় বুলেটিন।

বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, আসামে দু লক্ষের বেশি ও বিহারে অন্তত ১৫ হাজার বন্যা দুর্গত মানুষ ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া বন্যায় রেল লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গত রোববার থেকে উত্তর-পূর্বঞ্চলগামী সব ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে।

তবে প্রতিবেশী মেঘালয় রাজ্যে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে বলে এএফপিকে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

এদিকে স্থানীয় পুলিশের বরাত দিয়ে এএফপির প্রতিবেদন জানায়, নেপালে ৪৮ হাজারের বেশি বাড়িঘর বন্যায় তলিয়ে গেছে। গত জুনের শেষ দিক থেকে শুরু হওয়া বর্ষা মৌসুমে এখন পর্যন্ত নেপালে ১৫০ জনের প্রাণহানি হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে উত্তর-দক্ষিণ বিচ্ছিন্ন

গত কয়েক দিনে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের বন্যা পরিস্থিতির বেশ অবনতি হয়েছে। উত্তরবঙ্গে এখন পর্যন্ত শিশুসহ দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

এদিকে গত সপ্তাহে দক্ষিণবঙ্গে বন্যায় ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে রাজ্য প্রশাসন সূত্রে বলা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী টুইটারে বলেছেন, “সারা দেশের বন্যা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। আগে রাজ্যে দক্ষিণবঙ্গের ব্যাপক অংশ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবার উত্তরবঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”

তিনি বলেন, ২৪ ঘণ্টাই পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। ত্রাণ ও উদ্ধারের কাজও চলছে।

বিহারের কিষানগঞ্জে হাঁটু সমান পাণিতে স্টেশন ডুবে থাকায় ১৩ আগস্ট থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে ভারতীয় রেলওয়ে। সোমবার বিভিন্ন জাতীয় ও রাজ্য সড়ক পানির তলায় ডুবে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।

এদিকে দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের রেল ও সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ হয়ে পড়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব বেনারকে বলেন, ‘‘যে রাস্তা থেকে জল নেমেছে সেখানে দ্রুত মেরামতির কাজ চলছে। বাকি রাস্তা থেকে জল নামলেই যাতে অন্তত ধীরে হলেও যান চলাচল শুরু হতে পারে তার ব্যবস্থা হচ্ছে।’’

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছাতেও প্রশাসন অসুবিধায় পড়েছে বলে বেনারকে জানান ত্রাণ দপ্তরের এক আধিকারিক।

তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কলকাতা থেকে পরিতোষ পাল ও গৌহাটি থেকে ঝুমুর দেব।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।