মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন ৫৮ শব্দ সৈনিক
2017.07.11
ঢাকা
মহান মুক্তিযুদ্ধে শব্দ সৈনিক হিসেবে অবদান রাখায় ৫৮ জন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ৪৪তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সোমবার এ আদেশ জারি করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
ওই সভায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অংশগ্রহণকারী এবং মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠনের এসব শব্দ সৈনিককে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এই স্বীকৃতির মাধ্যমে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে চরমপত্র খ্যাত এম আর আখতার মুকুল, চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত, কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীর, তিমির নন্দীর মতো ব্যক্তিদের এই সম্মান দেওয়া হলো। তবে এদের অনেকেই ইতিমধ্যে পৃথিবী ত্যাগ করেছেন।
এই নিয়ে মোট ২৫৩ জন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এই স্বীকৃতি পেয়েছেন। এর আগে ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর ১০৮ জন শব্দ সৈনিককে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
প্রায় সাড় চার দশক পর সরকারের এই স্বীকৃতিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন স্বীকৃতিপ্রাপ্তদের অনেকে।
“যে ঘোষণা এসেছে, সেটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের,” বেনারকে বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীর।
তিনি বলেন, “স্বাধীনতার এত বছর পরে অবশেষে গেজেট হয়েছে এটা সত্যি। তবে আমাদের অনেক বন্ধুরা মারা গেছে। তারা জীবনে দেখে যেতে পারল না যে, তারা গেজেটভুক্ত হলো। এটা কি কম দুঃখের!”
“মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রও যে আলাদা একটা ফ্রন্ট ছিল, সে স্বীকৃতি সত্যিই বড় গর্বের,” আপ্লুত হয়ে বলেন ফকির আলমগীর।
যেভাবে গড়ে ওঠে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই রাতেই দশজন সাহসী সৈনিকের উদ্যোগে শুরু হয় চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের কাজ।
মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় সেখান থেকে প্রথমবারের মতো শোনা যায় ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গান। তবে সেদিন দুপুরেই পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় বন্ধ হয়ে যায় এ বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম।
তবে থেমে যাননি তাঁরা। কালুরঘাটের পতনের পর আগরতলা ও ত্রিপুরার বিভিন্ন জায়গা থেকে বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে শব্দ সৈনিকদের দুটি দল। এরপর ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন হয়। তখন ভারত সরকারের সহায়তায় কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সম্প্রচার শুরু করে।
দেশের জন্য অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধাদের মতো স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দসৈনিকরাও স্বাধীনতার বিজয়ের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কণ্ঠ যুদ্ধ চালিয়ে যান।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ বেনারকে বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে এ দেশের শিল্পীরা ত্যাগী, নিরহংকার এবং নির্লোভ। তারা যুদ্ধে যে অবদান রেখেছিলেন, সেটাও এই মানসিকতা থেকেই। তবে রাষ্ট্র যদি দায় মোচনের জন্য স্বীকৃতি প্রদান করে, তবে সেটা করতেই পারেন।
তবে তাঁর মতে, “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি অনন্য দিক, যেটা বিশ্বের অন্যান্য যুদ্ধের সঙ্গে পার্থক্য তৈরি করে দেয়। তাই এটি নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।”
হাসান আরিফ বলেন, “এর মাধ্যমে এই বেতার কেন্দ্রের মূল চেতনা, সেখানে যে গানগুলি হয়েছিল তা কখন লেখা বা ধারণ করা; যে সংবাদ পাঠ হয়েছে, সেসবের বিস্তারিত জানা যেত। কারণ, এখনো অনেকে বেঁচে আছেন। তাঁদের কাছ থেকে অনেক কিছুই জানা সহজ হতো।”
স্বীকৃতি পেলেন যাঁরা
যেসব শব্দ সৈনিকেরা এবার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন; মাহজাবীন বেগম (কুইন), পরিতোষ কুমার সাহা, মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম (অনু ইসলাম), মো. আজহারুল ইসলাম, মো. আবু নওশের, প্রয়াত সারোয়ার জাহান, প্রয়াত রেজওয়ানুল হক, আ ম শারফুজ্জামান, এ এম শফিউর রহমান (দুলু), প্রয়াত মো. হযরত আলী বয়াতী, মহিউদ্দিন আহমেদ, মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ ও মঞ্জুশ্রী নিয়োগী।
গেজেটে আরো যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁরা হলেন- প্রয়াত সুবল দত্ত, আমিনুর রহমান, মৃণাল ভট্টাচার্য, প্রয়াত প্রবাল চৌধুরী, উমা খান, কল্যাণী ঘোষ, সুজিত রায়, একরামুল হক চৌধুরী, গীতশ্রী চৌধুরী, প্রয়াত শাহ সালাউদ্দিন সাজ্জাদ, প্রয়াত হরেন্দ্র চন্দ্র লাহিড়ী, মিলন ভট্টাচার্য্য, অনামিকা নেওয়াজ (অনামিকা চাকলাদার), এস এম মহসিন, ছায়া রায়, প্রয়াত গজেন্দ্র লাল রায়, জয়শ্রী চৌধুরী, মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন, আবু বকর সিদ্দীক প্রধান, এস কে কে সিদ্দিক, মোজাম্মেল হক, সাজেদা খাতুন, খামিরুল ইসলাম প্রধান, আবুল কালাম আজাদ, প্রয়াত মোশারফ হোসেন মশু।
এছাড়া রয়েছেন ধীরেন্দ্র নাথ নমদাস, প্রয়াত শমসের আলী প্রধান, মালা খুররম, শিবু রায়, শুক্লা ভদ্র, এনামুল হক, প্রয়াত ফয়েজ আহমদ, নিরঞ্জন অধিকারী (সবুজ চক্রবতী), ফকির আলমগীর, প্রয়াত এম আর আকতার মুকুল, প্রয়াত জহুরুল হক, সুভাষ দত্ত, বেগম মুশতারি শফি, সুব্রত সেনগুপ্ত, চিত্তরঞ্জন ভুইয়া, প্রয়াত খন্দকার রাজু আহমেদ, তিমির নন্দী, ডা. দিলীপ কুমার ধর, বেগম ফিরোজা চৌধুরী ও প্রয়াত ম. মামুনের নাম।