ভিন্নমতের বই প্রকাশের দায়ে একুশে মেলায় স্টল পেলো না আদর্শ প্রকাশনী
2023.01.19
ঢাকা
সরকারের উন্নয়ন নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করে লেখা তিনটি বই প্রকাশ করায় বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় প্রকাশনা সংস্থা আদর্শ প্রকাশনীকে বার্ষিক একুশে গ্রন্থমেলায় স্টল বরাদ্দ দেয়নি সংস্থা বাংলা একাডেমি।
“আমার প্রকাশনী সংস্থা থেকে প্রকাশিত তিনটি বইয়ে সরকারবিরোধী মত রয়েছে বলে গ্রন্থমেলায় আদর্শ প্রকাশনীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা সংবিধানবিরোধী এবং মুক্ত মত প্রকাশের পথে মারাত্মক বাধা,” বেনারকে বলেন আদর্শ প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাহাবুব রাহমান।
তিনি জানান, লেখক জিয়া হাসানের ‘উন্নয়ন বিভ্রম’, ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা’ এবং ফাহাম আব্দুস সালামের ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ এই তিনটি বইয়ে সরকারের সমালোচনা রয়েছে বলে বাংলা একাডেমি আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে।
প্রসঙ্গত, ওই তিন লেখকের মধ্যে ফাহাম বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জামাতা। অপর দুই লেখকও সংবাদপত্রে প্রকাশিত কলামে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত সরকারের উন্নয়ননীতি ও অর্থনৈতিক নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে থাকেন।
তবে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া মেলায় “নিষিদ্ধ নয়” বরং “বইমেলার নীতিমালা অনুযায়ী আদর্শের স্টল বরাদ্দ স্থগিত রাখা হয়েছে,” বলে বেনারকে জানান অমর একুশে বইমেলা-২০২৩ আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব মুজাহিদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “পুলিশ, কয়েকজন প্রকাশক ও পাঠকের আপত্তির কারণে আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এই প্রকাশনী থেকে এমন কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে যেগুলোতে সরকারের সমালোচনা রয়েছে যা রাজনৈতিক বিতর্কের সৃষ্টি করতে পারে।”
আদর্শের “স্টল বাতিল হবে কিনা- এ বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি,” জানিয়ে তিনি বলেন, আগামীকাল শুক্রবার পরিচালনা পরিষদের সভায় “স্টল রাখা হবে, নাকি শুধু কয়েকটি বই বাজেয়াপ্ত করা হবে” সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
তবে কোন কোন বই সম্পর্কে অভিযোগ, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি মুজাহিদুল ইসলাম।
এদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো বই বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়নি বলে দাবি করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার।
“আমরা এই ধরনের কোনো বক্তব্য দেইনি বা কোনো প্রকাশনীকে রাখা বা না রাখার বিষয়ে কিছু বলিনি। এই দাবি সত্য নয়,” বলেন হাফিজ আক্তার।
মুজাহিদুল ইসলামের বরাত দিয়ে বৃহস্পতিবার দৈনিক সমকাল এক প্রতিবেদনে জানায়, গত বছর বইমেলায় অংশ নেয়া ৫৩৪টি প্রকাশনীর মধ্যে এবার মেলার তালিকা থেকে একমাত্র আদর্শ প্রকাশনীই বাদ পড়েছে।
আদর্শকে স্টল দিতে তিন লেখকের অনুরোধ
জিয়া হাসান, ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ও ফাহাম আব্দুস সালাম বাংলা একাডেমিকে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন।
‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা’ বইয়ের লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বেনারকে জানান, বিভিন্ন সংবাদপত্রে টেকসই উন্নয়ন, পলিসি স্ট্যাডি এবং উন্নয়ন বিষয়ে তিনি লেখালেখি করেন।
তাঁর এই বইতে প্রকাশিত প্রায় ৮০ শতাংশ লেখাই দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত কলাম, জানান তিনি।
বইটিতে “কাউকে গালি দেওয়া হয়নি, কোনো কটুকথা বলা হয়নি,” জানিয়ে তিনি বলেন, “বইয়ের প্রায় সব কনটেন্টই পলিসি স্ট্যাডি এবং বিকল্প প্রস্তাবনা।”
“হ্যাঁ, বইতে আমি উন্নয়ন বিশ্লেষণ এবং উন্নয়ন সমালোচনা করি এবং তার পক্ষে অনেক তথ্য-উপাত্ত নির্ভর যুক্তি উপস্থাপন করি। এখন রাজনৈতিক সমালোচনার ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমার বইকে উছিলা করে প্রায় ৩০০ লেখকের প্রকাশনাকে মেলায় স্টল না দেওয়ার সিদ্ধান্তে আমি হতাশ,” বলেন তৈয়্যব।
আদর্শ প্রকাশনীর স্টল স্থগিতের সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য বাংলা একাডেমিকে অনুরোধ জানিয়ে ‘উন্নয়ন বিভ্রম’ বইয়ের লেখক জিয়া হাসান বেনারকে বলেন, “আমি উন্নয়ন বিভ্রমসহ আমার সব বই বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে তুলে নিচ্ছি, কারণ আমি চাই না আমার লেখা বই প্রকাশ করতে গিয়ে কোনো প্রকাশনা সংস্থার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ুক বা কারো রুটি-রুজি ক্ষতিগ্রস্ত হোক।”
বেনারের কাছে প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেন ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ বইয়ের লেখক ফাহাম আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, “আমি আদর্শকে অনুরোধ করব, তারা যেন আমার বই স্টলে না রাখে এবং বাংলা একাডেমিকে অনুরোধ করব তারা যেন এই শর্তে আদর্শকে স্টল দেন।”
“যদি আমার বইটিই সমস্যা হয়ে থাকে, ওটা বাদ দিয়ে তাদের অন্য বইগুলো বিক্রি করতে দিন,” বাংলা একাডেমির প্রতি আহ্বান রাখেন ফাহাম।
মির্জা ফখরুলের উদ্বেগ
বাংলা একাডেমির বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ না দেওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে তিনি এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ, ক্ষোভ, প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন।
“বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলা মুক্তবুদ্ধি চর্চার উপযুক্ত স্থান হিসেবে যুগ যুগ ধরে বিবেচিত হয়ে আসছে,” মন্তব্য করে বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল বলেন, “সরকারবিরোধী ও ভিন্নমতের বই প্রকাশের অভিযোগে আসন্ন বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীর স্টল স্থগিত করা খুবই উদ্বেগজনক এবং নিন্দনীয়। এ ঘটনা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ।”
“বইমেলা কোনো সরকার বা একক দলের নয়; বরং দলমত-নির্বিশেষে সবার প্রাণের মেলা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল, কিন্তু তিনটি ভিন্ন মতের বইয়ের জন্য ছয় শতাধিক বই প্রকাশকারী সংস্থা আদর্শ প্রকাশনীর স্টল স্থগিত করার মাধ্যমে বাংলা একাডেমি ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হলো,” বলেন ফখরুল।
‘প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে’
আদর্শ প্রকাশনীকে মেলায় স্টল না দেয়া প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বেনারকে বলেন, “একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বুদ্ধিজীবী বা লেখকদের দায়িত্ব সরকারের সমালোচনা করা। সরকারে সমালোচনা করার অপরাধে যখন একটি প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয় তখন এটা স্পষ্ট যে, সরকার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বন্ধ করতে চায়।”
“একজন লেখক কী লিখল তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, সে যা লিখল তা প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। বাংলা একাডেমির এই অবস্থান থেকে বোঝা যায় তারা সরকারে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবে সহায়ক ভূমিকা রাখছে,” বলেন আনু মুহাম্মদ।
বাংলা একাডেমির এই আচরণ কোনভাবেই গণতান্ত্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলে মন্তব্য করেন আনু মুহাম্মদ।
এদিকে বইমেলায় স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক সংবাদ সম্মেলনে আদর্শ প্রকাশনীর মাহাবুব রাহমান বলেন, “অমর একুশে গ্রন্থমেলায় লেখক ও প্রকাশকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত রাখতে হবে।”
অবিলম্বে আদর্শকে এর প্রাপ্যতা ও যোগ্যতা বিবেচনা করে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দসহ “যে ৩টি বইয়ের ব্যাপারে বাংলা একাডেমি আপত্তি জানিয়েছে, সেগুলো মেলায় প্রদর্শন ও বিক্রির পূর্ণ নিশ্চয়তা” দাবি জানান তিনি।