অভিজিৎ হত্যাদিবস সামনে রেখে নেদারল্যান্ডে নিষিদ্ধ বইয়ের মেলা

বেনার ডেস্ক
2017.02.23
ওয়াশিংটন ডিসি
ফ্রিডম বুক ফেয়ারের লোগো। ফ্রিডম বুক ফেয়ারের লোগো। ফেব্রুয়ারি ২০১৭।
সৌজন্যে: ফ্রিডম বুক ফেয়ার ডট কম

ঢাকায় অমর একুশে বই মেলায় এবার অংশ নিতে পারেনি বহুল আলোচিত ‘শুদ্ধস্বর’ প্রকাশনী। জঙ্গি আক্রমণে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা শুদ্ধস্বরের কর্ণধার কবি আহমেদুর রশিদ টুটুল সপরিবারে দেশ ছেড়েছেন। আশ্রয় নিয়েছেন নরওয়েতে।

ঢাকায় প্রাণের মেলায় অংশ নিতে না পারা তাঁর মতো বেশ কিছু প্রকাশক, লেখক ও ব্লগার এবার জড়ো হচ্ছেন নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে।

‘মুক্তমনা’ বাংলা ব্লগ এবং হেগ পিস প্রজেক্টস এর যৌথ আয়োজনে সেখানে দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘মুক্তি বইমেলা—হেগ, ২০১৭’।

এই মেলায় থাকবে নিষিদ্ধ বইয়ের প্রাধান্য। বাংলা একাডেমিতে নিষিদ্ধ বই, প্রকাশক ও প্রকাশনা সংস্থাগুলো সেখানে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশে নিষিদ্ধ নয়, তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে নিষিদ্ধ বিভিন্ন ভাষার বই ওই মেলায় স্থান পাবে।

নিষিদ্ধ বইকে কেন এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে বেনারকে মুক্তমনার বর্তমান কর্ণধার রাফিদা আহমেদ বন্যা বলেন, “বলতে পারেন, সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে এটা প্রতিবাদ। বুদ্ধির মুক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এই মেলার মুখ্য উদ্দেশ্য। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও সত্যভাষী বই বাংলাদেশে ও অন্যান্য দেশে নিষিদ্ধ হয়েছে। সুস্থ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এসব বই সবার পাঠ্য হওয়া উচিত।”

২৪ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি চার দিনের এই মেলায় সরাসরি অংশ নিচ্ছে পাঁচটি বাংলাদেশি প্রকাশনী। যাঁরা সরাসরি মেলায় যেতে পারছেন না, তাঁরা বই পাঠিয়ে দিচ্ছেন।

নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে মুক্তির মেলা

আহমেদুর রশিদ টুটুল বেনারকে বললেন, “এটা মূলত বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়া লেখক ও ব্লগারদের সম্মিলন। এটা অবশ্যই অভিজিৎকে স্মরণ করে। সঙ্গে আরও যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের স্মরণে।”

“এটা প্রতীকী বইমেলা। এর উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের স্বাধীন ও মুক্তমতের বিরোধী হেফাজতি বা সরকারি সব ধরনের তৎপরতা বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরা,” জানান টুটুল।

বই প্রকাশনা ও ঢাকার বই মেলা পুরো জীবন বদলে দিয়েছে টুটুলের। ড. অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করার কারণে জঙ্গিরা তাঁকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে এবং গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেছে। এখন বেঁচে থাকাটাই তার কাছে অনেক বড় ব্যাপার।

একুশের বই মেলা নিয়ে তার অনুরাগ ও ক্ষোভ দুটোই আছে। ঢাকার বই মেলায় ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ আরোপের ঘটনা সম্পর্কে তিনি বললেন, “এটা যেন বাংলা একাডেমির অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রাজপথের সংগ্রামের মাধ্যমে ‘শ্রাবণ’ অধিকার ফিরে পেয়েছে। কয়েক দিন আগে একটা কবিতার বই নিষিদ্ধ করা হলো। বাংলা একাডেমি যদি পাইরেটেড বইয়ের বিরুদ্ধে এমন খড়্গ হস্ত হতো তাহলে বরং সাহিত্যের কিছুটা উপকার হতো।”

অভিজিৎ​ হত্যাদিবস সামনে রেখে মেলা

‘মুক্তমনা’ ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায় খুন হয়েছিলেন একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার সময়।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি’র কাছে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এই লেখককে আক্রমণ করে ইসলামি জঙ্গিরা। সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী ও লেখক রাফিদা আহমেদ বন্যা। মারাত্মক আহত বন্যা প্রাণে বেঁচে গেলেও অভিজিৎ বাঁচতে পারেনি।

অভিজিৎ হত্যাদিবস সামনে রেখে হেগ-এর এই আয়োজনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাফিদা আহমেদ বন্যা।

এই আয়োজনে সংগঠকের দায়িত্বে আছেন প্রবাসী ব্লগার নাস্তিকের ধর্মকথা। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের বইমেলায় ধর্মীয় ও প্রশাসনিক আক্রমণ চলছে। ফেব্রুয়ারিতেই খুন হয়েছিলেন থাবা বাবা এবং অভিজিৎ রায়। হুমায়ুন আজাদের ওপর চাপাতি আক্রমণ হয়েছিল এই বই মেলায়। মত প্রকাশের অপরাধে নিহত সমস্ত লেখক, ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্টকে স্মরণ করা এই বইমেলার অন্যতম উদ্দেশ্য।

নিষিদ্ধ বই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এই বইমেলার নাম হচ্ছে—ফ্রিডম বুক ফেয়ার। প্রতিপাদ্য হচ্ছে: 'In solidarity with those who are putting their lives on the line for freedom of expression'. ফলে দেশ বিদেশের সমস্ত নিষিদ্ধ বই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।”

মেলা আয়োজনের প্রেক্ষাপট

মেলা আয়োজনের প্রেক্ষাপট হিসেবে লেখক, ব্লগার ও প্রকাশকদের হত্যার ঘটনাগুলো উল্লেখ করে আয়োজকেরা একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন।

বিবৃতিতে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার সমালোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের একুশে বইমেলা প্রতিবছর নানাভাবে রাষ্ট্রীয় তথা প্রশাসনিক আক্রমণের মুখে পড়ছে। বাংলা একাডেমি হওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের লেখক, প্রকাশক ও পাঠকদের শক্ত অবলম্বন। কিন্তু মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তা প্রকাশের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সেই বাংলা একাডেমি মৌলবাদী রক্তচক্ষুর ভয়ে শঙ্কিত।

এ রকম প্রেক্ষাপটেই গত বছর ২১ ফেব্রুয়ারি নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে ‘বাংলাদেশ অলটারনেটিভ বুক ফেয়ার’ নামে একদিনের একটি বইমেলার আয়োজন করা হয়। সেই আয়োজনের ধারাবাহিকতায় এবার চার দিনের এই আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন করা হচ্ছে।

বাঙালির সঙ্গে মিলেছে তুর্কি, সোমালি ও ডাচ

নাস্তিকের ধর্মকথা বেনারকে বলেছেন, গত বছর সম্পূর্ণভাবে এই বইমেলা ছিল বাংলাদেশ বিষয়ক। কিন্তু এবার অন্যান্য যেসব দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আক্রান্ত, সেসব দেশকেও যুক্ত করা হয়েছে। তুরস্ক ও সোমালিয়ার লোকজনও এতে যুক্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশ থেকে শুদ্ধস্বর, শ্রাবণ, অঙ্কুর, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড এবং আদর্শ প্রকাশনী মেলায় অংশ নিচ্ছে।

বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি, আরবি এবং ডাচ ভাষার বইও থাকছে। ডাচ, ইউকে, তুরস্ক, সোমালিয়ান, আফ্রিকান সব মিলে মেলায় অংশ নিচ্ছে ১৫ টি প্রকাশনী। তুরস্কে যেসব বই নিষিদ্ধ হয়েছে তার সবগুলোই এই মেলায় প্রদর্শিত হবে।

মেলায় থাকছে একটি কবিতা সন্ধ্যা ও বাংলাদেশ বিষয়ে দুটো প্যানেল আলোচনা। বাংলাদেশ বিষয়ক প্যানেল আলোচনা ও বইমেলায় অংশ নিতে জার্মানি, নরওয়ে এবং কানাডা থেকেও বাঙালি ব্লগাররা আসবেন।

বইমেলার অনুষ্ঠানসূচি

মেলায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে দুটি প্যানেল আলোচনা হবে। কবি দাউদ হায়দারকে নিয়ে বাংলা কবিতা সন্ধ্যা আয়োজন করা হয়েছে। তুরস্কের পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্যানেল আলোচনা হবে। সোমালিয়ান কবিতা সন্ধ্যা এবং ধর্মীয় সমাজে এলজিবিটি আন্দোলনের পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্যানেল আলোচনা আয়োজন করা হয়েছে।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেবেন মুক্তমনা ব্লগের প্রধান রাফিদা আহমেদ বন্যা, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, ইস্টিশন ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রবাসী ব্লগার নুর নবী দুলাল এবং নৃবিজ্ঞানী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসরিন সিরাজ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।