মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ‘আপত্তিকর’ নিবন্ধ লিখে চাকরিচ্যুত অধ্যাপক আদালতে যাবেন

জেসমিন পাপড়ি
2020.09.10
ঢাকা
200910_DU_Teacher_Terminated_620.jpg ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান।
[ছবি: অধ্যাপক মোর্শেদের পরিবারের সৌজন্যে]

নিজের লেখায় মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও সংবিধান সম্পর্কে অবমাননাকর তথ্য উল্লেখ করার অভিযোগে অব্যাহতি পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান প্রথমে রাষ্ট্রপতি, পরে আদালতের শরণাপন্ন হবেন বলে জানিয়েছেন।

তাঁর মতে, তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় “বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন না মেনে কেবলমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে” তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহত দেওয়া হয়েছে।”

বুধবার বিকেলে সিন্ডিকেট সভায় মার্কেটিং বিভাগের এই অধ্যাপককে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার বেনারকে এর প্রতিক্রিয়া জানান অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান।

অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের কাছে আবেদন করব। তাতে সাড়া না পেলে পরবর্তীতে আইনের আশ্রয় নেব।”

উল্লেখ্য, অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াত সমর্থক বলে পরিচিত শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের যুগ্ম-আহ্বায়ক।

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এভাবে চাকুরিচ্যুত করার ঘটনা নজিরবিহীন,” উল্লেখ করে অধ্যাপক মোর্শেদ বলেন, “এই ঘটনায় প্রমাণ হলো, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে আর মুক্তচর্চার অধিকার বা সুযোগ নেই।”

বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় মোর্শেদ হাসানকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তি​যুদ্ধ ও সংবিধান অবমাননার অভিযোগ এনে তাঁকে চাকরিচ্যুত করার সুপারিশ করে এই অভিযোগের তদন্তে গঠিত ট্রাইব্যুনাল। পরে সিন্ডিকেট বিষয়টি অনুমোদন করে।

এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) মুহাম্মদ সামাদ বেনারকে বলেন, “অধ্যাপক মোর্শেদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্তের প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সুপারিশে সম্মতি জানায় গঠিত ট্রাইব্যুনাল।”

“এরই ভিত্তিতে সিন্ডিকেট প্রফেসর মোর্শেদকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে,” বলেন তিনি।

২০১৮ সালের ২৬ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে ‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ শিরোনামে একটি কলাম লেখেন মোর্শেদ হাসান খান।

ওই লেখায় বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য থাকার অভিযোগ তোলে সরকারি দল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে ছাত্রলীগ তখন বিক্ষোভ–সমাবেশ করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকেও ওই নিবন্ধের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। এর মাঝে মোর্শেদ হাসান দুঃখ প্রকাশ করে লেখার আপত্তকির অংশ প্রত্যাহার করেন।

এতে বিশ্ববদ্যিালয় কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হয়নি। ওই বছরের ২ এপ্রিল মোর্শেদ হাসান খানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি উপ-উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

ওই কমিটি অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায়। এর প্রেক্ষিতে অধ্যাপক মোর্শেদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে বিষয়ে আইনি সুপারিশ করতে ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে দায়িত্ব দেয় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট।

বেআইনি সাজা

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে “এই অপরাধে কাউকে চাকুরিচ্যুত করার ‍সুযোগ নেই,” জানিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আলী আর রাজী বেনারকে বলেন, “অধ্যাপক মোর্শেদকে চাকুরিচ্যুত করে বিশ্ববিদ্যালয় বেআইনি কাজ করেছে।”

তিনি বলেন, “আইন অনুযায়ী কেবলমাত্র পরীক্ষা সংক্রান্ত দুর্নীতি বা নৈতিক স্খলনের প্রমাণ হলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চাকুরিচ্যুত করা যায়।”

আলী রাজী বলেন, “তারপরেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ধরনের কাজ করছে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতায় যারা আছেন, তাঁরা দেখাতে চান যে, তাঁরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। তাঁদের রাজনৈতিক মুরুব্বিরা এতে খুশি হন বলে তাঁরা মনে করেন।”

“দেশবিরোধী কাজ বা রাষ্ট্রদ্রোহীতার জন্য সাজার কথা আইনে বলা নেই। এ ধরনের অভিযোগের তদন্ত করতে রাষ্ট্রপতি বা চ্যান্সেলরের অনুমতি নিতে হয়। এক্ষেত্রে সেটাও নেওয়া হয়নি,” বলেন আলী আর রাজী।

সাদা দলের প্রতিবাদ

মোর্শেদ হাসান খানকে চাকরিচ্যুত করার প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি–জামায়াত সমর্থক শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল।

সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, “একটি দৈনিক পত্রিকায় লিখিত একটি নিবন্ধে কিছু অনাকাক্ষিত বক্তব্যের কারণে নিবন্ধটি প্রত্যাহার, দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা সত্ত্বেও তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদান করার ঘটনা নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত।”

“কেবলমাত্র ভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতের অনুসারী হওয়ায় সম্পূর্ণ বিধি বহির্ভূতভাবে তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। আমরা এ ধরনের নজিরবিহীন ও ন্যাক্কারজনক সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি,” বিবৃতিতে বলা হয়।

নিবন্ধে যা লিখেছিলেন

২০১৮ সালের ২৬ মার্চ জামায়াত সমর্থক বলে পরিচিত জাতীয় দৈনিক নয়া দিগন্তে অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানের লেখা ‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ শিরোনামের নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়।

এতে তিনি লেখেন, “আওয়ামী নেতাদের বেশিরভাগই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাঁদের পরিবার পরিজনসহ ভারতে চলে গেলেন এদেশবাসীকে মৃত্যু ফাঁদে ফেলে দিয়ে নেতৃত্বহীন অবস্থায়। যাকে ঘিরে এ দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখত সেই শেখ মুজিবুর রহমানও।”

তিনি লেখেন, “জাতির এ সংকটকালীন মুহূর্তে ত্রাতারূপে আবির্ভূত হন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। দেশপ্রেমের মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত এই টগবগে যুবকের কণ্ঠে ২৬ মার্চ রাতে বজ্রের মতো গর্জে ওঠে স্বাধীনতার ঘোষণা।”

মোর্শেদ হাসান নিবন্ধে লেখেন, “স্বাধীনতার ডাক এসেছিল শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর, তার আগে নয়। আমার জানা মতে, তিনি কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি।”

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য দেওয়া অপরাধ। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ হওয়া এবং তাঁকে পাক হানাদার বাহিনী গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নেওয়ার বিষয়গুলো ঐতিহাসিক সত্য এবং এগুলো না মানাটা দণ্ডনীয় অপরাধ।

এদিকে ড. মোর্শেদকে চাকরিচ্যুত করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ।

সংগঠনরে কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ আল মামুন এক বিবৃতিতে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনোই স্বাধীনতা বিরোধীদের দোসররা থাকতে পারে না। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ সবসময় আপসহীন থাকবে।

‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ও সংবিধান লঙ্ঘনকারী’ আখ্যা ​দিয়ে ড. মোর্শেদ হাসান খানকে গ্রেপ্তার করারও দাবি জানায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।