ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদন: বাংলাদেশে করোনাকালে বেনারনিউজসহ অর্ধশত ওয়েবসাইট বন্ধ

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.10.14
ঢাকা
201014-BD-freedom-house-protest1000.jpg ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে ঢাকায় মানববন্ধন। ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮।
[এএফপি]

ইন্টারনেটে বাংলাদেশিদের স্বাধীনতার মান গত বছরের চেয়ে অবনমিত হওয়ার কথা জানিয়েছে মার্কিন মানবাধিকার সংগঠন ফ্রিডম হাউস।

সারা বিশ্বে ইন্টারনেট স্বাধীনতার ওপর বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থাকে ‘আংশিক স্বাধীন’ হিসাবে উল্লেখ করে বলা হয় করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে বাংলাদেশে ‘নিপীড়নমূলক’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়েরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত বিশ্বের ৬৫টি দেশে জরিপ চালিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বাংলাদেশেসহ ২৬টি দেশে এই বছর ইন্টারনেট স্বাধীনতার অবনতি ঘটেছে।

“মহামারি যখন ডিজিটাল প্রযুক্তির ওপর সমাজগুলোর নির্ভরতা বাড়িয়ে দিয়েছে, ঠিক তখনই ইন্টারনেটের স্বাধীনতা কমেছে,” প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এক বিবৃতিতে বলেন ফ্রিডম হাউসের প্রেসিডেন্ট মাইকেল আব্রামোভিচ।

আইনের শাসন ও ব্যক্তির গোপনীয়তা সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া না গেলে ডিজিটাল প্রযুক্তি খুব সহজেই রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয় ফ্রিডম হাউসের ওই প্রতিবেদনে।

করোনাকালে বেনারসহ বাংলাদেশে বন্ধ অর্ধশত সাইট

প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে সরকার বেনারনিউজের বাংলা এবং ইংরেজি সংস্করণসহ মোট ৫০টি সাইট বন্ধ করেছে।

ফ্রিডম হাউজ বলছে, গত এপ্রিলে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রভাবের ওপর জাতিসংঘের একটি গোপন নথির ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বেনারনিউজের বাংলা ও ইংরেজি সংস্করণ বন্ধ করে দেয়া হয়।

সংগঠনটির মতে, নেত্রনিউজের মতো ছোট সংবাদপোর্টালও বাংলাদেশে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত নিউজ পোর্টাল বেনারনিউজ এখনও বাংলাদেশে বন্ধ আছে।

তবে বাংলাদেশে যেসব সাইট বন্ধ করা হয়েছে সেগুলো “গুজব ও অপপ্রচারের সাথে যুক্ত,” বলে বেনারকে জানান টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার।

মন্ত্রী বলেন, “সরকারের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীগুলো কোন কোন সাইট অপপ্রচারের সাথে যুক্ত, সেগুলো চিহ্নিত করে একটি স্বচ্ছ ব্যবস্থার মাধ্যমে সাইট বন্ধ করার সুপারিশ করে। সেই ভিত্তিতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন সাইট বন্ধ করে থাকে।”

বেনারনিউজ অপপ্রচারের সাথে যুক্ত নয়, তাহলে কেন বন্ধ করা হলো—এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বেনারকে বলেন, “বেনারনিউজ যদি মনে করে বাংলাদেশে এটি বন্ধ করা ভুল হয়েছে, তাহলে তারা বিটিআরসি’র কাছে আবেদন করতে পারে। আবেদন করলে পুর্নবিবেচনা করার সুযোগ তো আছেই।”

উল্লেখ্য, বেনারনিউজের পক্ষ থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে এ বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

তবে মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার জানান, যেসব সাইট বন্ধ করা হয়েছে, তাঁর জানামতে সেগুলোর কোনোটিই সাইট খুলে দেয়ার জন্য বিটিআরসি’র কাছে আবেদন করেনি।

এদিকে “সরকার কোনো সাইট বন্ধ করতেই পারে,” মন্তব্য করে বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমুনিকেশন এর প্রধান নির্বাহী এ.এইচ.এম.বজলুর রহমান বেনারকে বলেন, “তবে একটি সাইট কেন বন্ধ করা হলো জনগণের তা জানার অধিকার আছে। কিন্তু বাংলাদেশের একটি সাইট কেন বন্ধ করা হলো তা বলা হয় না।”

তাঁর মতে, কোন কোন সাইট কেন বন্ধ করা হলো সেব্যাপারে সরকার সার্কুলার দিয়ে জনগণকে জানাতে পারে। তাতে ভুল বোঝাবুঝির জায়গা থাকবে না।

বজলুর রহমান বলেন, “আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধী নই। কিন্তু এই আইনের অপব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়।”

ফ্রিডম হাউজের রেটিংয়ে গত বছর ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের নম্বর ছিল ৪৪। এবার এই নম্বর দু্ই পয়েন্ট কমে এসেছে ৪২।

‘একটি কালো আইন’

গত ৮ অক্টোবর ইউরোপভিত্তিক ফ্রন্টলাইন ডিফেন্ডার বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা করে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রণয়নের পর দুবছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২০৪টি মামলায় ২০৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর এই মামলাগুলোর অধিকাংশই ২০২০ সালে রুজু করা হয়েছে বলে জানায় ফ্রন্টলাইন ডিফেন্ডার।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে “একটি কালো আইন,” বলে মন্তব্য করেন এই আইনে আটক সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

তিনি বেনারকে বলেন, “পুলিশ অথবা সরকার চাইলে যে কোনো সময় এই আইনের অপব্যবহার করতে পারে। সম্প্রতি রাজবাড়ী জেলায় একজন তাঁর ফেসবুক পোস্টে প্রধানমন্ত্রীর নামের পর একটি কমা না দেয়ায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক হয়ে কারাগারে আছেন।”

এদিকে “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজন রয়েছে,” বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু জাফর মো. শফিউল আলম ভূঁইয়া।

তবে তাঁর মতে, “এই আইনের কিছু কিছু ধারায় পুলিশকে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া আছে। এই ধরনের ব্যাপক ক্ষমতার কারণে আইনটির অপব্যবহার হতে পারে।”

উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারায় পুলিশকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তারের ও ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি জব্দ করার ক্ষমতা দেয়া আছে।

“আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার দেখতে চাই না। তাই এই আইনের কিছু কিছু ধারার সংশোধন প্রয়োজন,” বলেন ড. শফিউল আলম ভূঁইয়া।

নিউজ সাইট বন্ধের ব্যাপারে তিনি বলেন, “সাইট বন্ধের কিছু পদ্ধতি থাকা উচিত। কোনো সাইট রাতারাতি বন্ধ করা সঠিক পদ্ধতি নয়। সাইটগুলোকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।”

“সংবাদ সাইটগুলোকে নিবন্ধিত করার কাজে শুরু করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। এই নিবন্ধন শেষ হলে পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আসতে পারে,” মনে করেন ওই শিক্ষক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।