কুমিল্লায় সংখ্যালঘুদের বাড়িতে আগুন: ৫০০ আসামি
2020.11.02
ঢাকা
ফেসবুকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমান্যুয়েল ম্যাক্রোর প্রতি সমর্থন জানানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুমিল্লার একটি গ্রামে হিন্দুদের অন্তত চারটি বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় প্রায় ৫০০ জনকে আসামি করে সোমবার তিনটি পৃথক মামলা হয়েছে।
ঘটনার প্রতিবাদে আক্রান্তরা সমাবেশ করতে চাইলে স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করে।
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আন্দিকোট ইউনিয়নের কোরবানপুর গ্রামে গত রোববার এই ঘটনা ঘটে।
“সম্ভাব্য অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর জন্য এবং শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সোমবার ওই ইউনিয়নে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে,” বেনারকে বলেন মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অভিষেক দাশ।
হামলার শিকার আন্দিকোট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক বনকুমার শিব, লিটন দেবনাথ এবং সন্দীপ দেবনাথসহ আরো দুই ব্যক্তি মোট পাঁচশজনকে অভিযুক্ত করে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছেন।
এর আগে ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেন এবং কুমিল্লার পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের মধ্যে পাঁচজন ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারে রোববার তাদের তাৎক্ষণিক সাজা দেওয়া হয়েছে।”
“আমাদের কাছে ভিডিও আছে। ফুটেজ দেখে স্থানীয় সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ঘটনার সাথে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে,” যোগ করেন তিনি।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে গত শনিবার থেকেই ওই এলাকায় অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে।
কুরবানপুরের ফ্রান্স প্রবাসী কিশোর দেবনাথ কিশান ওই পোস্টে লিখেছিলেন, “ফ্রান্সের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য ফরাসী প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রো বিভিন্ন অসামাজিক বা অমানবিক চিন্তাভাবনাকে শায়েস্তা করার যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।”
তাঁর প্রতিবেশী কোরবানপুর ব্লুবার্ড কিন্ডারগার্টেনের প্রধান শিক্ষক শংকর দেবনাথ পোস্টটিতে মন্তব্য করেন, “স্বাগতম প্রেসিডেন্টের উদ্যোগকে।” পাশ্ববর্তী আন্দিকুট গ্রামের অনিল ভৌমিকও সেখানে সমর্থনসূচক মন্তব্য করেন।
এরপর গুজব রটে যায় যে, শংকর এবং অনিল ইসলাম ধর্মের অবমাননা করেছেন। এই অভিযোগে শনিবার তাঁদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি শান্ত হয়নি।
“রবিবার আমার আবাসিক কার্যালয়ে এবং শঙ্করসহ আরও চারজনের বাড়িতে হামলা করে শত শত মানুষ। এক পর্যায়ে তারা বাড়ি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে,” বেনারকে বলেন ইউপি চেয়ারম্যান বনকুমার শির।
“তারা একটি মন্দিরও ধ্বংস করেছে,” যোগ করেন তিনি।
পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে জানিয়ে ভাঙারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “সংঘাত এড়ানোর জন্য রোববার মুরাদনগর স্কুল মাঠে স্থানীয়দের নিয়ে বৈঠক করা হয়। শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে সবাই সেখানে সন্মত হয়েছিল। কিন্তু একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে সামাল দেওয়া যায়নি।”
ওসি জানান, হামলার ঘটনায় জেলা প্রশাসনের নির্দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে পাঁচজন হামলাকারীকে রবিবার তাৎক্ষণিকভাবে ১৮ দিন থেকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য অপরাধীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
এদিকে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য একটি স্বার্থান্বেষী মহল স্পর্শকাতর ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও জনশৃঙ্খলা বিনষ্টের চেষ্টা করছে বলে সোমবার এক প্রেসনোটে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
কোনো প্রকার গুজবে কান না দেওয়া ও “আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার বর্বর প্রবণতা” থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে ওই প্রেসনোটে বলা হয়, “এ ধরনের সকল বেআইনি কর্মকাণ্ড কঠোর হস্তে দমন করা হবে।”
হেফাজতের ‘আল্টিমেটাম’
বাংলাদেশে চলমান ফ্রান্স বিরোধী আন্দোলনের বৃহত্তম বিক্ষোভ করে দেশটিকে বয়কটের জন্য সরকারকে ২৪ ঘন্টার সময় বেঁধে দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
ঢাকার শান্তিনগর মোড়ে সোমবার পুলিশের বাঁধায় ফ্রান্স দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচির সমাপনী ঘোষণাকালে সংগঠনের মহাসচিব জুনায়েদ আহমেদ বাবুনগরী এই ‘আল্টিমেটাম’ দেন।
অন্যান্য বক্তার মতো তিনিও ফ্রান্সের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন, ফরাসি পণ্য বর্জন ও রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের দাবিতে সরকারকে সময় বেঁধে দেওয়ার কথা জানান তিনি।
একই সাথে কোরান অবমাননাকারীদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে বিল পাশ করার দাবি জানান তিনি।
ভাটারা থেকে এসে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া মোহাম্মদ মনজুরুল হক নামের এক আন্দোলনকারী বেনারকে বলেন, “যদি ২৪ ঘন্টার মধ্যে হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে নেওয়া না হয়, তবে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করার কথা বলেছেন মহাসচিব।”
এর আগে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ চত্ত্বরে অনুষ্ঠিত সমাবেশে দাবি না মানলে সরকার বিরোধী আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হয়। গত শুক্রবার একই জায়গা থেকে সম্মিলিত ইসলামি দলগুলোর ব্যানারে সরকার উৎখাতের হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
সোমবারের সমাবেশে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আল্লামা মামুনুল হক বলেন, “ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে ফ্রান্স দূতাবাসের সাথে সাথে বর্তমান সরকারের ক্ষমতার মসনদও বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেবো।”
এ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বেনারকে বলেন, “ফ্রান্সের ঘটনাপ্রবাহে মুসলমানদের মধ্যে একটা ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। তবে তারা চাইলেই দেশকে রাজনৈতিকভাবে অস্থীতিশীল করতে পারবে না।”
“হেফাজতের নেতৃত্বে এর আগেও একবার নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার তা মোকাবেলা করেছে। আশা করা যায়, তারা অযৌক্তিকভাবে সরকারকে বিব্রত এবং জনজীবনের শান্তি বিনষ্ট করবে না।”
কেরানীগঞ্জ থেকে এসে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া সালেহ আহমেদ সুহেইল বেনারকে বলেন, “আমাদের মিছিল নিয়ে আসার কথা ছিল। পুলিশের বাঁধার কারণে তা পারিনি। উত্তরা, যাত্রাবাড়িসহ আরো বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ বাঁধা দিয়েছে।”
এদিকে হেফাজতের বিক্ষোভকালে “কাউকে বাঁধা দেওয়া হয়নি,” জানিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ওয়ালিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “তবে কোনোরকম বিশৃঙ্খলা যাতে না হয়, সেজন্য পুলিশের প্রস্তুতি ছিল।”
হেফাজতের সাবেক নেতা ও তাকওয়া ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মাওলানা গাজী ইয়াকুব বেনারকে জানান, ২০১৩ সালের শাপলা চত্ত্বরের জমায়েতের পর ঢাকায় এত বড় জমায়েত করেনি হেফাজতে ইসলাম।
“আজকের বিক্ষোভে কমপক্ষে লক্ষাধিক লোক হয়েছে,” বলে বেনারকে জানান হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন।
তবে পুলিশের ভাষ্যমতে সোমবার ৪০-৪৫ হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন হেফাজতের সমাবেশে।