সাত মাস পর জামিন পেলেন সাংবাদিক কাজল, ছাড়া পাবার অপেক্ষায় পরিবার

পুলক ঘটক
2020.12.17
ঢাকা
সাত মাস পর জামিন পেলেন সাংবাদিক কাজল, ছাড়া পাবার অপেক্ষায় পরিবার ভারত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অভিযোগে বেনাপোল সীমান্ত থেকে আটকের পর যশোরের আদালতে শফিকুল ইসলাম কাজলকে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ৪ মে ২০২০।
[বেনারনিউজ]

দুই মাস নিখোঁজ থাকার পর সাত মাস ধরে বন্দি সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে বৃহস্পতিবার একসঙ্গে দুটি মামলায় জামিন দিয়েছে হাইকোর্ট। 

“কাজলকে কেন জামিন দেওয়া হবে না জানতে চেয়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর রুল জারি করেছিল আদালত। সেই রুল যথাযথ ঘোষণা করে তাঁকে জামিন দিয়েছে আদালত,” বেনারকে বলেন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) সারোয়ার হোসেন। 

হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর থানায় দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পৃথক দুই মামলায় কাজলের জামিনের প্রশ্নে দেওয়া রুলের শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই জামিনের আদেশ দেয় বলে জানান সারোয়ার হোসেন। 

এর আগে একই হাইকোর্ট বেঞ্চ শেরেবাংলা নগর থানায় দায়েরকৃত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আরেকটি মামলায় কাজলকে ২৪ নভেম্বর জামিন দেয়। 

“সবগুলো মামলায় জামিন হওয়ায় কাজলের মুক্তিতে আর কোনো বাধা রইল না,” বেনারকে বলেন তাঁর আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। 

বৃহস্পতিবার জামিন হলেও বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কাজলের জেল থেকে ছাড়া পেতে আরো তিন-চারদিন লেগে যেতে পারে বলে আদালতের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বেনারকে জানান তাঁর ছেলে মনোরম পলক। 

“কাল এবং পরশু দুইদিন সাপ্তাহিক ছুটি। এরপর উচ্চ আদালতের এই আদেশ জজকোর্ট হয়ে জেলখানায় যাবে। নয় মাস পর বাবাকে কাছে পাব,” বলেন পলক। 

কারাগারে নেওয়ার পর পরিবারের কেউ কাজলের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাননি জানিয়ে পলক বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার বন্ধ রয়েছে, আদালতেও তোলা হয় না। তবে সপ্তাহে একদিন টেলিফোনে কথা বলার সুযোগ দিয়েছে।” 

গত ১০ মার্চ সন্ধ্যায় নিজ পত্রিকা পক্ষকালের হাতিরপুল এলাকার কার্যালয় থেকে বের হন সাংবাদিক কাজল। এরপর থেকে তাঁর কোনো সন্ধান না পেয়ে ১১ মার্চ চকবাজার থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন তাঁর স্ত্রী জুলিয়া ফেরদৌসী নয়ন। 

নিখোঁজ থাকাকালে তাঁর সন্ধানের দাবিতে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন করোনা পরিস্থিতি উপেক্ষা করে আন্দোলন করে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন কাজলের সন্ধানের দাবি জানায়। 

মাগুরা-১ আস‌নের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শেখর গত ৯ মার্চ রাজধানী ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় কাজ‌ল ও মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীসহ ৩২ জ‌নের বিরু‌দ্ধে ডি‌জিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। 

মামলায় বানোয়াট তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ আনার পরদিনই কাজল নিখোঁজ হন। 

পরে তাঁর বিরুদ্ধে ১০ ও ১১ মার্চ হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর থানায় আরও দুটি মামলা দায়ের করা হয়, মামলাগুলোর বাদী সরকারদলীয় স্থানীয় নেতারা। 

৫৭দিন নিখোঁজ থাকার পর গত ২ মে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত থেকে কাজলকে আটকের কথা জানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাপ পরা অবস্থায় এই সাংবাদিককে ক্যামরার সামনে হাজির করা হয়। 

তাঁর বিরুদ্ধে ভারত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অভিযোগ এনে মামলা দিয়ে যশোর কারাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ঢাকায় আনার পর গত ২৩ জুন কাজলকে শেরেবাংলা নগর থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিচারকের মুখোমুখি করা হয়। 

হাকিম আদালত সেদিন কাজলের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে। তারপর আরো বহুবার তাঁর জামিন আবেদন নামঞ্জুর হয়েছে। 

কাজলের জামিনে আনন্দিত জানিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল ১৯ এর দক্ষিণ এশিয়া এবং বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের পরিচালক ফারুক ফয়সাল বেনারকে বলেন, “সরকার অহেতুক তাঁকে আটকে রেখেছিল।” 

“কাজলের প্রতি যা হয়েছে তা অবিচারের পর্যায়ে পড়ে, এজন্য নিন্দা জানাই,” মন্তব্য করে ফয়সাল বলেন, “আর্টিকেল ১৯ এর পক্ষ থেকে আমরা কাজলের বিষয়টি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনেও তুলেছিলাম।” 

হয়রানি চলছেই

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ২৩৩ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে দুই জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। নিখোঁজের পর উদ্ধার হয়েছেন একজন। 

এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হুমকির শিকার হয়েছেন ৩৯ জন। সরকার সমর্থিতদের হুমকির শিকার হয়েছেন আরো ১৯ জন। সংবাদ প্রকাশের কারণে সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে মোট ৮৯টি। 

তবে আর্টিকেল ১৯ বলেছে, গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৭৯টি মামলা হয়েছে যাতে ভুক্তভোগীর সংখ্যা ৩৭০। এর মধ্যে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা আছে ৩৭টি, যেখানে আসামির সংখ্যা ৬৩। 

আর্টিকেল ১৯’র তথ্যমতে, এই সময়কালে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ১২টি মানহানির মামলা এবং আরো ৩১টি নানারকম হয়রানিমূলক মামলায় ৭০ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। 

তবে আর্টিকেল ১৯ এর মনিটরিং শাখার কর্মকর্তা আসিয়া আখতার আফ্রির মতে, “মামলার প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে আমাদের ধারণা।” 

“কারণ আমরা কেবল বিভিন্ন সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত প্রতিবেদন মনিটরিং করে এই তথ্য পেয়েছি। এমন অনেক মামলা থাকতে পারে যেগুলোর সংবাদ প্রকাশিত হয়নি,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।