গার্মেন্টস শ্রমিকদের সমর্থনে বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর অ্যাপারেল সামিট বয়কট
2017.02.22
শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড বাংলাদেশে অনুষ্ঠিতব্য অ্যাপারেল সামিট বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে। সম্প্রতি বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনকারী যেসব শ্রমিককে ছাঁটাই ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের সমর্থনে ব্র্যান্ডগুলো এই সিদ্ধান্ত নেয়।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজারের পরিধি ৩০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। অ্যাপারেল সামিট এই খাতের বৃহত্তম ও মর্যাদাপূর্ণ অনুষ্ঠান। ঢাকায় আয়োজিত এই সম্মেলনটি আগামী শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।
গত ডিসেম্বরে ঢাকার কাছে আশুলিয়ায় হাজার হাজার শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করেন। ২০১৩ সালে শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৫ হাজার ৩০০ টাকা। তাঁরা মজুরি ১৬ হাজার টাকায় উন্নীত করার দাবিতে মাঠে নামেন।
অভিযোগ ওঠে বেতন বৃদ্ধি নিয়ে কোনো আলোচনার পরিবর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হয়। নির্বিচারে শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়, মামলা করা হয় হাজার হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে।
হল্যান্ডের বিখ্যাত ব্র্যান্ড সিঅ্যান্ডএ অ্যাপারেল সামিটে অংশগ্রহণ না করার বিষয়টি নিশ্চিত করে একটি বিবৃতি দিয়েছে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, সিঅ্যান্ডএ, এইঅ্যান্ডএম এবং ইন্ডিটেক্সের মতো প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএ অ্যাপারেল সামিটে অংশ নিচ্ছে না।
“আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দৃঢ় আহ্বান জানাচ্ছি, সরকার যেন শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। আমরা সরকারকে বিশেষভাবে যেসব বৈধ শ্রমিক প্রতিনিধিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি,” বলেন সিঅ্যান্ডএ মুখপাত্র থর্সটেন রলফস।
বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সুইডেনের এইচঅ্যান্ডএমও সম্মেলন বয়কটের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সম্মেলনটির আয়োজক বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ), যে সংগঠন দেশের সাড়ে ৪ হাজার তৈরি পোশাক কারখানার প্রতিনিধিত্ব করে।
বিজিএমই বরাবরের মতো এবারও শ্রমিক হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট সিদ্দিকুর রহমান সমালোচকদের কারখানায় এসে নিজের চোখে পরিস্থিতি দেখে যাওয়ার অনুরোধ করেন। আশুলিয়ার শ্রমিক অসন্তোষ সম্মেলনে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলেও জানান তিনি।
“কোনো ব্র্যান্ড সম্মেলন বয়কট করছে, এমন কোনো খবর আমার কাছে নেই,” বেনারকে জানান বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট সিদ্দিকুর রহমান।
তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক সংগঠন ক্লিন ক্লোদস ক্যাম্পেইন ব্র্যান্ডগুলোর এই পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছে। সরকার এবং আয়োজকদের জন্য এই খবর অস্বস্তিকর বলেও মন্তব্য করেছে তারা।
“যতক্ষণ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা শ্রমিকদের মুক্তি না দেওয়া হচ্ছে, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার না হচ্ছে, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও শ্রমিকদের নাজেহাল করার ঘটনা বন্ধ না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্র্যান্ডগুলোর এ ধরনের সম্মেলন বর্জন করাই শ্রেয়। কারণ তা তৈরি পোশাক শিল্পের টেকসই উন্নয়নের পরিপন্থী হবে,” ওয়েবসাইটে বলেন সিসিসির মুখপাত্র মিরিয়াম ভ্যান হুটেন।
এ দফায় শ্রমিকদের আন্দোলন দু’সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়েছিল। গত ডিসেম্বরের ১১ তারিখে শুরু হওয়া ওই আন্দোলন থামাতে দেড় হাজার শ্রমিক ছাঁটাই ও ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। চুরি, ডাকাতি, লুটতরাজ, ভাঙচুর, চাঁদাবাজির মতো মামলা দেওয়া হয় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিক অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে সিঅ্যান্ডএ ফাউন্ডেশন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। এতে বলা হয়, “এখনও শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এতে তাঁদের কর্মস্পৃহা নষ্ট হচ্ছে। ফাউন্ডেশন হিসেবে এটি শুধু আমাদের কাজের অবমূল্যায়ন করছে তা-ই নয়, শিল্পের এগিয়ে যাওয়াকেও বাধাগ্রস্ত করছে। সে কারণেই ফাউন্ডেশন ঢাকা অ্যাপারেল সামিট বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
এর আগে গত ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর চিঠি দেয় ১৯টি ব্র্যান্ডসহ মোট ২১ টি প্রতিষ্ঠান। ওই চিঠিতে জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে একটি মজুরি বোর্ড গঠনের সুপারিশ করা হয়।
ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, “আমরা অবৈধ ধর্মঘট বা সহিংস প্রতিবাদের পক্ষে নই, আমরা এও বিশ্বাস করি না লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এগুলোই কার্যকর পদক্ষেপ। কিন্তু শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে এটিই স্বীকৃত এবং সত্য।”
শ্রমিকদের ওপর দায় চাপানোর সুযোগ নেই
বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কাস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বাবুল আক্তার ব্র্যান্ডগুলোর সম্মেলন বয়কটের দায় শ্রমিকদের ওপর না চাপানোর অনুরোধ করেছেন।
“শ্রমিকেরা যখন মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করছিল, তখন বিজিএমইএ বা সরকার আলোচনার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তারা দমন-নিপীড়নের পথে হেঁটেছে। বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহার করে শ্রমিকদের ধরে নিয়ে গেছে। হাজারো শ্রমিক ছাঁটাই করেছে। এই পরিস্থিতিতে ব্র্যান্ডগুলো সম্মেলনে নাও আসতে পারে,” বেনার নিউজকে বলেন বাবুল আক্তার।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, নামী ব্র্যান্ডগুলো যে সম্মেলনে আসছে না সে ব্যাপারে সরকার ওয়াকিবহাল। এ নিয়ে গত মঙ্গলবার ছুটির দিনে দুই দফায় শ্রম মন্ত্রণালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
তবে, গতকাল বুধবার রাতে এই প্রতিবেদন লেখার আগ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আশুলিয়ায় আতঙ্ক
গত মঙ্গলবার সরেজমিন দেখা যায়, তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা অঞ্চল আশুলিয়ার শ্রমিকদের মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। মো. জাহাঙ্গীর ৫৩ দিন জেল খেটে গত বৃহস্পতিবার জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। আশুলিয়ার জামগড়ায় তাঁর টিনশেডের ভাড়া বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন।
“ওই রাতে আমি ঘুমাচ্ছিলাম। মধ্যরাতে দরজায় আওয়াজ। ওরা জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে শুরু করে। এক পর্যায়ে আমি দরজা খুলে বের হলে আমাকে ধরে নিয়ে যায়,” জাহাঙ্গীর বলছিলেন।
জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মোট ৯টি মামলা দেওয়া হয়েছে। তাঁর অন্যান্য সহকর্মীদের বিরুদ্ধেও মামলার সংখ্যা অনেক। তিনি বলছিলেন, নয়টি মামলায় মাসে নয় দিন আদালতে হাজিরা দিতে হলে কোনো কারখানাই তাঁকে কাজে নেবে না।
শ্রমিকদের ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, মিথ্যা মামলা দায়ের ও হয়রানির অভিযোগ সম্পর্কে পুলিশ সুপার (কারখানা) মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বেনারকে বলেন, এ বিষয়ে কিছু তাঁর জানা নেই।
আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহসীন কাদের বেনারকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
“বাংলাদেশ থেকে বাজার সরিয়ে নেওয়ার জন্য একটি পক্ষ দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে। উস্কানিদাতাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে,” বেনারকে বলেন মোহসীন কাদের।