গার্মেন্টস শ্রমিক নেতারা জামিন পেলেও মামলা ঝুলছে

ঢাকা থেকে প্রাপ্তি রহমান
2017.02.28
রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভারের সামনে বকেয়া বেতনের দাবিতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের রাস্তা অবরোধ। রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভারের সামনে বকেয়া বেতনের দাবিতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের রাস্তা অবরোধ। ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

গত বছরের শেষভাগে গার্মেন্টস খাতে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করায় ৩৪ জন শ্রমিক নেতাকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত অ্যাপারেল সামিটকে কেন্দ্র করে দরকষাকষির ফলে তাঁদের সবাই জামিনে মুক্তি পান। তবে তাই বলে তাঁরা এখনও শঙ্কামুক্ত নন।

গ্রেপ্তার হওয়া শ্রমিক নেতাদের মধ্যে সর্বশেষ ব্যক্তিও গতকাল মঙ্গলবার জামিনে মুক্তি পান। বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন এর সভাপতি বাবুল আক্তার এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। সংগঠনটি গ্লোবাল ট্রেড ইউনিয়ন ইন্ডাস্ট্রি অলের সদস্য।

“বড় ব্র্যান্ডগুলো অ্যাপারেল সামিটে অংশ নেবে না মর্মে হুমকি দেওয়ার পরই মূলত সরকার ও পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ নড়েচড়ে বসে। তারা বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছেছে,” বেনারকে বলেন বাবুল আক্তার।

গার্মেন্টস খাতে বিশ্বের বৃহত্তম সম্মেলন অ্যাপারেল সামিটকে সামনে রেখে শ্রম মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বিজিএমইএ বৈঠকে বসে ইন্ডাস্ট্রি অলের এ দেশীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে। ওই বৈঠকে গ্রেপ্তার শ্রমিক নেতাদের মুক্তি, ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের কাজ ফিরিয়ে দেওয়া বা ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং আশুলিয়ায় সরকার যেসব শ্রমিক সংগঠন বন্ধ করে দিয়েছিল সেগুলোর সাংগঠনিক কাজকর্ম শুরুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।

এর আগে ২৩ ফেব্রুয়ারি সম্মেলনের দুদিন আগে এইচঅ্যান্ডএম, ইনডিটেক্স (যারা), সিঅ্যান্ডএ এবং চিবোসহ পাঁচটি ব্র্যান্ড সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানায়। আশুলিয়ায় শ্রমিকদের সমর্থনে এই সিদ্ধান্ত বলেও তারা জানিয়ে দেয়।

তবে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শেষ পর্যন্ত ওই সম্মেলনে এইচঅ্যান্ডএম, যারাসহ ক্রেতাদের প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন।

“আমি আগেও বলেছিলাম বড় ব্র্যান্ডগুলো সামিটে অংশ নেবে না, এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। বাংলাদেশে পোশাক শিল্প কারখানার কর্মপরিবেশ এখন উন্নত। যারা সমালোচনা করছেন, তারা না দেখে ও না বুঝে করছেন,” বেনারকে বলেন সিদ্দিকুর রহমান।

গত বছরের ডিসেম্বরে কয়েক হাজার শ্রমিক মজুরি বাড়ানোর দাবিতে ঢাকার কাছে আশুলিয়ার রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে। মজুরি ৫ হাজার ৪০০ টাকা থেকে তিনগুণ বাড়ানোর দাবি তাঁদের। বিক্ষোভ দমাতে ১ হাজার ৬০০ শ্রমিক ছাঁটাই ও ৩৪ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। চুরি, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও চাঁদাবাজির মতো মামলায় প্রায় ১ হাজার ৫০০ কর্মীকে জড়ানো হয়।

২০১৯ সালের আগে মজুরি বাড়ানো হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন মালিকেরা। বিজিএমইএ তখন জানায়, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে মালিক পক্ষের প্রায় ১০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার ক্ষতি হয়েছে।

তবে শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যে পৌঁছানোর বিষয়টিকে শ্রমিকদের বিজয় হিসেবে দেখছে গ্লোবাল ট্রেড ইউনিয়ন ইন্ডাস্ট্রি অল।

“এর মাধ্যমে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার যে অধিকার তা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনার পথ খুলে গেল,” ইন্ডাস্ট্রি অলের মুখপাত্র ভল্টার সানচেজকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।

সরকারি হিসেবে, বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের বাজার ৩০ বিলিয়ন ইউএস ডলারের। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগ আসে পোশাক খাত থেকে। কিন্তু এই খাতে যুক্ত শ্রমিকদের মজুরি কম, প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের জীবনমানের অবস্থাও করুণ।

কম মজুরি, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাব, অনুপযোগী কর্মপরিবেশ ইত্যাদি নিয়ে প্রায় দুই দশক ধরে আলাপ-আলোচনা চললেও এ নিয়ে সত্যিকারের আলোচনা শুরু হয় রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর। ২৩ এপ্রিল ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক নিহত হন।

আলোচনার কেন্দ্রে শ্রম অসন্তোষ

অ্যাপারেল সামিটের আগে বিজিএমইএ ও শ্রমিক সংগঠনগুলো ঐকমত্যে পৌঁছায়। কিন্তু সম্মেলনেও অসন্তোষের কথা ঘুরে ফিরে আসে। ওই সামিটের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বার্তা সংস্থা বাসস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে জানায়, “গার্মেন্টস কারখানাগুলোয় সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা সহায়তা করতে পারেন। সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।”

সম্মেলনে ট্রেড ইউনিয়ন ইস্যুতে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে জড়ান। ঢাকার গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী মার্শা বার্নিকাট বলেন, মজুরি বৃদ্ধির দাবি আদায়ে যেসব শ্রমিক আন্দোলন করেছেন তাঁদের ছাঁটাই করা হয়েছে। এ নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসম্যান ও ব্র্যান্ডগুলোর উদ্বেগ আছে। তাঁরা চান সব শ্রমিক নেতার মুক্তি ও তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার।

মার্শা বার্নিকাটের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন প্রসঙ্গে শুধু বাংলাদেশকে নিয়ে কথা হয়। চীন, ভিয়েতনাম বা পাকিস্তানকে নিয়ে কথা হয় না। চীনে প্রতিদিন কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটলেও তাদের নিয়ে আলোচনা নেই।

“যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭ শতাংশে ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ৩৫ শতাংশে ইউনিয়ন আছে। তাহলে কীভাবে বাংলাদেশে শতভাগ কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন থাকবে,” প্রশ্ন রাখেন তোফায়েল আহমেদ।

মুক্তি পেলেও ভীতি কাটছে না

গ্রেপ্তার হওয়া শ্রমিক নেতারা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু মামলা প্রত্যাহার হয়নি। প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক এখনো বেকার। সব মিলিয়ে এখনো অস্থির সময় পার করছেন আন্দোলনকারীরা।

গ্লোবাল ট্রেড ইউনিয়ন ইন্ডাস্ট্রি অল বলেছে, মামলা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

আশুলিয়া থানা পুলিশ এই গ্রেপ্তার ও মামলা বিষয়ে মন্তব্য করতে নারাজ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সরকারের সঙ্গে শ্রমিকদের আলোচনা চলছে। সহসাই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

এদিকে জেলে থাকা মো. ইব্রাহীম শনিবার মুক্তি পেয়েছেন। তিনি ভাবতেও পারেননি গ্রেপ্তার হওয়ার কথা।

“১৯ ডিসেম্বর শ্রম অসন্তোষ নিয়ে তিন মন্ত্রী আমাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আশুলিয়ার জামগড়ায় ফ্যান্টাসি কিংডমে আমাদের ডেকে পাঠায়। ভেবেছি হয়তো আবার আলোচনায় বসবে। কিন্তু আমাকে ধরে নিয়ে নয়টা মামলা দিল,” বেনারকে বলেন ইব্রাহীম।

একই অবস্থা জাহাঙ্গীরেরও। দুই সন্তানের জনক জাহাঙ্গীর বেনারকে বলছিলেন, মালিকপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দেয়নি। কিন্তু কাজে অনুপস্থিত থাকার অভিযোগে ছাঁটাই করেছে। মামলাও চলছে।

মমতাজ বেগম ১৯ বছর ধরে গার্মেন্টসে কাজ করেন। বেনারকে তিনি বলছিলেন, কেউ শ্রমিকদের দায় নেয় না।

“তাঁর গার্মেন্টসে কিছু বেতন বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু মালিকদের তেজ ও ঝালও বেড়েছে। আগে ঘণ্টায় যত পিস কাপড়ের অর্ডার দিত, এখন তার দ্বিগুণ বা তিনগুণ টার্গেট দেয়,” জানান মমতাজ।

গার্মেন্টস শ্রমিক–কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামরুল আহসান বেনারকে বলেন, শ্রমিকেরা অভিযোগ করে না ছাঁটাই হওয়ার ভয়ে। আর আন্দোলন করলে কী ফল হতে পারে তা আশুলিয়ার ঘটনার পর আন্দোলনকারীরা টের পাচ্ছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।