আরও তিন বছর বাংলাদেশের পোশাক কারখানা তদারকির সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ক্রেতাদের

পুলক ঘটক
2017.06.30
ঢাকা
সাভারের একটি গার্মেন্টসে কাজ করছেন শ্রমিকরা। সাভারের একটি গার্মেন্টসে কাজ করছেন শ্রমিকরা। ০১ এপ্রিল, ২০১৪।
নিউজরুম ফটো

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প কারখানাগুলো আরও তিন বছর তদারকি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট ‘অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ’। তবে এতে তীব্র আপত্তি প্রকাশ করেছে পোশাক রপ্তানিকারক ও শ্রমিক নেতারা। বাংলাদেশ সরকারও বিষয়টি অবগত নয় বলে জানিয়েছে।

রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় কর্ম পরিবেশ তদন্তের জন্য ইউরোপের ক্রেতা ব্র্যান্ডগুলো ২০১৩ সালের মে মাসে একটি যৌথ চুক্তির আওতায় এই জোট গঠন করেছিল।

আগামী বছর এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও নিজেদের কার্যক্রম গুটিয়ে না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘অ্যাকর্ড’ নামে পরিচিত এই জোটটি। বরং তদারকির ক্ষেত্রে নতুন কিছু বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার।

গত বৃহস্পতিবার প্যারিসে এক বৈঠকের পর এক বিবৃতির মাধ্যমে নতুন এই চুক্তির ঘোষণা দেয় অ্যাকর্ড।

বাংলাদেশের আপত্তি

বৈদেশিক এই তদারকি চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের সরকার, গার্মেন্টস মালিক ও শ্রমিকদের আপত্তি আছে। ২০১৮ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে কারখানা পরিদর্শনের ব্যাপারে চুক্তি নবায়ন না করার পক্ষে মত দিয়ে আসছে সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা।

গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বেনারকে বলেন, “তারা (অ্যাকর্ড) পাঁচ বছর পর চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু এরপর কেন পরিদর্শন করতে চায়? এ নিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা চাই সরকারের নেতৃত্বে কারখানা পরিদর্শন করা হোক। কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ।”

তিনি বলেন, “রানা প্লাজার পর একটা পরিস্থিতিতে তাঁরা পরিদর্শন করেছিল। কিন্তু সারা জীবন তদন্ত করবে, তা হয় না।”

পরবর্তীতে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান হবে বলে মনে করেন তিনি।

শ্রমিক নেতাদের পক্ষ থেকেও এমন মতই এসেছে। বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বেনারকে বলেন, “অ্যাকর্ড যে পদ্ধতিতে কাজ করে সেটা সঠিক নয়। তারা সরাসরি কারখানা বন্ধের নির্দেশ দেয়। অথচ তাদের কাজ করার কথা বাংলাদেশ সরকারের অধীনে। তাদের আপত্তি থাকলে সেটা সরকারকে জানানোর কথা।”

তিনি বলেন, “এভাবে গার্মেন্টস কারখানার ওপর বিদেশি তদারকি চলতে দেওয়া যায় না। এটা দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। বিদেশ নির্ভরতা নয়।”

অ্যাকর্ড নতুন চুক্তি করার আগে বাংলাদেশ সরকারকে এ ব্যাপারে কিছুই অবহিত করেনি বলে বেনারকে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপার।

তিনি বলেন, “বিদ্যমান চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালের পর বাংলাদেশ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তদন্ত কার্যক্রম চালানোর কথা।

“আমরা তাদের একসঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু তারা হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি। অ্যাকর্ড এক হাজার পাঁচ শ কারখানা পরিদর্শন করেছে। আমরা সরকারের দিক থেকেও প্রায় সম পরিমাণ কারখানা পরিদর্শন করেছি। তাতে তো কোনো সমস্যা হয়নি,” বলেন মিকাইল শিপার।

গত বছর এক অনুষ্ঠানে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুও বলেছিলেন, “আমরা মনে করি না ২০১৮ সালের পর আর অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের আমাদের এখানে থাকার প্রয়োজন আছে।”

কী আছে চুক্তিতে?

ইউরোপের নাম করা ১৫টি ফ্যাশন ব্র্যান্ড নতুন চুক্তিতে সই করেছে। এর মধ্যে রয়েছে কেমার্ট অস্ট্রেলিয়া, টার্গেট অস্ট্রেলিয়া, প্রাইমার্ক, এইচঅ্যান্ডএম, ইন্ডিটেক্স, সিঅ্যান্ডএ, ওটো, কিক, আলদি সাউথ, আলদি নর্থ, লিডল, টিসিবো, এলসি ওয়াইকিকি ও হেলি হানসেন।

এ ছাড়া ইসপিরিট, হিউরেন, বেস্টসেলার, উইবরা, স্কিমড গ্রিুপ, এন ব্রাউন গ্রুপ, পিভিএইচ, স্পেশালিটি ফ্যাশন গ্রুপ অস্ট্রেলিয়াও নতুন চুক্তিতে সই করবে বলে ইন্ডাস্ট্রিঅল ও ইউএনআইর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

আগের চুক্তির মতো নতুন চুক্তিতেও বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে ভবন, অগ্নি এবং বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। নতুন চুক্তিতে শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়টিকে আরও বিস্তৃত করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

নিরাপত্তার কারণে কোনো কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে অথবা স্থানান্তরের সময় শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।

শ্রমিকদের ইউনিয়ন করা, ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি না করা এবং শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বিস্তৃত করার মতো বিষয়ও রয়েছে। নতুন এই চুক্তি কারখানা মালিকেরা মেনে চলছে কি না সে জন্যে পরিদর্শন এবং তদারকিরও ব্যবস্থা থাকবে।

কারখানা সংস্কারে অগ্রগতি

গত ৮ মে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে অ্যাকর্ডের নির্বাহী পরিচালক রব ওয়েজ বলেছিলেন, “৭৭ শতাংশ কারখানায় সংস্কারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে এখনো বড় ধরনের নিরাপত্তা সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হয়নি।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের এক হাজার ছয় শ ৫৫টি কারখানা অ্যাকর্ডের অধীনে আছে। এর মধ্যে এক হাজার পাঁচ শ ৩৪টি কারাখানা পরিদর্শন করেছে সংস্থাটি। শতভাগ সংস্কার সম্পন্ন করেছে ৬৫টি, ভবনের কাঠামো সংস্কার হয়েছে ২০৯টি, বিদ্যুৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে ৬৪৯টি এবং অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে ৯২টি কারখানার।”

সংস্কারকাজে সন্তোষজনক অগ্রগতি না হওয়ায় ৭১টি কারখানার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে অ্যাকর্ড। এ ছাড়া প্রায় ৫৭৮টি কারখানাকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে তারা। সংস্কারকাজে সন্তোষজনক অগ্রগতি না হলে এসব কারখানার সঙ্গেও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে অ্যাকর্ড।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।