গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে হুমকির মুখে শিল্প উৎপাদন

রিয়াদ হোসেন
2023.06.06
ঢাকা
গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে হুমকির মুখে শিল্প উৎপাদন ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে একটি কারখানায় লোডশেডিংয়ের কারণে মেশিন বন্ধ থাকায় মুঠোফোনে লুডু খেলায় ব্যস্ত এই দুই শ্রমিক । ১ আগস্ট ২০২২।
বেনার নিউজ

দীর্ঘদিন ধরে চলা গ্যাস সংকটের মধ্যে নতুন করে শুধু হওয়া বিদ্যুৎ সংকট  শিল্প উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। দেশের প্রধান রপ্তানিমুখী শিল্প তৈরি পোশাকের কাঁচামাল সরবরাহকারী টেক্সটাইল খাতের স্পিনিং মিলের উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকই ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

সাভারের লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বেনারকে বলেন, “গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে কারখানার ইউনিট-২ বন্ধ করে দিয়েছি। এখানে একটি ইউনিট কোনো রকমে চালু রাখছি।”

একই গ্রুপের মালিকানাধীন নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় অবস্থিত ইনটিমেট স্পিনিং মিল নামে একটি কারখানাও একই সমস্যার কারণে বন্ধ রয়েছে।

কেবল টেক্সটাইল নয়, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে পোশাক কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং খরচও বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছে এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন।

সংগঠনটির সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বেনারকে বলেন, “সময় মতো উৎপাদন করতে ব্যর্থ হলে রপ্তানি করা যাবে না। ফলে ক্রেতারা ঝুঁকি কমানোর জন্য বাংলাদেশে ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিতে পারে।”

বস্ত্র কল ছাড়াও গ্যাস ও বিদ্যুৎ নির্ভর স্টিল, সিরামিক, সিমেন্টসহ অন্যান্য শিল্পও একইভাবে ভুগছে। এসব কারণে সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হলে তা উন্নয়ন কাজেও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

এ পরিস্থিতিতে আপাতত “দুঃখ প্রকাশ” ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ শনিবার সাভারে এক অনুষ্ঠানে বলেন, “কয়েকটা বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল না থাকায় লোডশেডিং বেড়ে গেছে, কিছুটা জনদুর্ভোগ হচ্ছে। এই কারণে আমরা খুবই দুঃখিত।

অবশ্য মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে দেওয়া বক্তব্যে তিনি নাগরিকদের ধৈয ধরার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আশা করি সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হবে।”

বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে লাগামহীনভাবে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি তথা গ্যাস, কয়লা ও ফার্নেস ওয়েল আমদানিতে অনেকটা প্রভাব পড়েছে। ফলশ্রুতিতে বর্তমানের এই অনাকাঙ্ক্ষিত লোডশেডিং। তবে আমরা খুব দ্রুতই জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছি।”

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ১৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, যার মধ্যে সোমবার ঘাটতি ছিল সর্বোচ্চ তিন হাজার ২৪ মেগাওয়াট।

এছাড়া পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে, তিন হাজার এমএমসিএফ (মিলিয়ন কিউবিক ফিট)। আর চাহিদা তিন হাজার ৭০০ এমএমসিএফ। গ্যাস চাহিদার ১৮ শতাংশই যায় শিল্প কারখানায়।

সক্ষমতার অর্ধেক ব্যবহার করতে পারছে শিল্পগুলো

গত ৩০ মে দেশের বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, বর্তমানে তাদের সদস্যভুক্ত কারখানাগুলো সর্বোচ্চ সক্ষমতার অর্ধেক ব্যবহার করছে।

তবে শিল্প উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো কোনো কারখানা বর্তমানে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় সক্ষমতার মাত্র এক-পঞ্চমাংশ ব্যবহার করে চলছে।

খোরশেদ আলম জানান, তার সাভারের সুতা উৎপাদনের ইউনিট সক্ষমতার মাত্র ৩৫ শতাংশ ব্যবহার করতে পারছে। তিনি এই প্রতিবেদককে তার গ্যাসের মিটারের একটি ছবি পাঠিয়েছেন। তাতে দেখা যায়, মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে তার মিলে গ্যাসের চাপ জিরোতে নেমে এসেছে। অথচ তার অনুমোদিত পিএসআই (পাউন্ড পার স্কয়ার ইঞ্চি বা গ্যাসের চাপ পরিমাপের একক) হলো ১০।

তিনি জানান, রাত ৯টার পর গ্যাসের চাপ কিছুটা বাড়লে তখন তিনি কিছু কাজ করতে পারেন। অথচ দিনের বেশির ভাগ সময় প্রেশার থাকে চার পিএসআইয়ের নিচে, যা দিয়ে উৎপাদন কাজ চালানো যাচ্ছে না।

এছাড়া ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে মূল্যবান যন্ত্রপাতিও নষ্ট হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “গত মাসে ২৪ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়েছে।”

কেবল খোরশেদ নন। একই তথ্য দিয়েছেন গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীর বেশ কয়েকজন শিল্প উদ্যোক্তা।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মাসাদুল আলম মাসুদ বেনারকে বলেন, “গ্যাসের প্রেশার দিনে থাকে না। রাতে কিছুটা পাওয়া যায়। আর এখন লোডশেডিং বেড়ে গেছে, দিনে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা হয়। এতে উৎপাদন নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে।”

এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে সরবরাহ চেইনে বিঘ্ন ঘটবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের কাছ থেকে মাল নিয়ে যারা সাইট চালান (নির্মাণ কাজ) সেগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে।”

ইশরাক স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিটিএমএ’র সহসভাপতি ফজলুল হক বেনারকে জানান, তার কারখানায় গ্যাস সংকট তেমন নেই। কিন্তু লোডশেডিং প্রতিদিন প্রায় সাত ঘণ্টা হচ্ছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন।”

দাম বাড়িয়েও সরবরাহ স্বাভাবিক করার প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়নি

গত জানুয়ারিতে সরকার শিল্প ও বিদ্যুতে ব্যবহার হওয়া গ্যাসের দাম বাড়ায় সর্বোচ্চ ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত। ফেব্রুয়ারি থেকে বর্ধিত মূল্য কার্যকর হয়। এ নিয়ে শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই জ্বালানি বিভাগের ব্যাখ্যায় বলা হয়, গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার উদ্দেশ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে।

এর চার মাস পার হলেও শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি।

এর মধ্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির কথা বলা হলেও এখনো পর্যন্ত তা হয়নি।

বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন সংবাদ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এক বছরের কম সময়ে গ্যাসের মূল্য বাড়ানো হয়েছে ৮৬ শতাংশ।…আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু দাম বৃদ্ধির পরে গ্যাস সরবরাহ অবস্থা অদ্যাবধি অত্যন্ত শোচনীয়, যা বর্তমানে অসহনীয় অবস্থায় উপনীত হয়েছে।”

বাজার হারানোর আশঙ্কা

পরিস্থিতির উন্নতি না হলে পোশাক রপ্তানিকারকরা বাজার হারানোর আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, “কারখানাগুলোতে প্রায় ৫ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, আবার সময় মতো উৎপাদনও করা যাচ্ছে না”

বিদেশি ক্রেতাদের সময় মতো পণ্য পাঠানো না গেলে ডিসকাউন্ট কিংবা ক্রয়াদেশ বাতিল হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, “অনিশ্চয়তা থাকলে ক্রেতারা পুরো ক্রয়াদেশ এখানে না দিয়ে কিছু অংশ অন্য দেশে নিয়ে যেতে পারে। পরিস্থিতি উন্নতি হলেও পরবর্তীতে ওই ক্রেতাকে সহজে আনা যাবে না। এখনই ক্রেতারা আমাদের কাছে পরিস্থিতি জানতে চাচ্ছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।