রপ্তানির লক্ষ্য ৬৭ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.07.20
ঢাকা
রপ্তানির লক্ষ্য ৬৭ বিলিয়ন ডলার  নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ চট্টগ্রাম বন্দরে ডেলিভারির জন্য অপেক্ষমান আমদানি পণ্য বোঝাই কাভার্ডভ্যান ও কন্টেইনারের সারি। ১৩ জুলাই ২০২২।
বেনার নিউজ

গত অর্থ বছরে দেশের আমদানি খরচ রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থ বছরের জন্য ৬৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার, যা রেকর্ড বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বুধবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এক বছরের এই রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেন।

এই ৬৭ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৫৮ বিলিয়ন ডলার পণ্য এবং ৯ বিলিয়ন ডলার সেবা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে এই রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা গেলে দেশের আমাদানি-রপ্তানির ব্যবধান কমানো যাবে এবং বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে। তারা আরও বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতি মন্দার মুখোমুখি হলে এই রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমাদের রপ্তানি তো বৃদ্ধি করতেই হবে। রপ্তানি বৃদ্ধি  হলে আমদানি-রপ্তানির মধ্যে যে ব্যবধান সেটি কিছুটা হলেও ঘুচানো যাবে।”

“তবে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা একটু বেশি ধরেই নির্ধারণ করতে হয়। সেদিক থেকে ৬৭ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক আছে। তবে এই লক্ষ্য আমার কাছে উচ্চাভিলাসী মনে হচ্ছে। কারণ আমরা গত অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৫২ বিলিয়ন ডলার,” যোগ করেন তিনি।

ড. মইনুল বলেন, “গত অর্থ বছরে আমদানি হয়েছে ৮০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আমাদানি ও রপ্তানির মধ্যে ব্যবধান ২৮ বিলিয়ন ডলার। আমাদের ২০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স যোগ করলেও আমদানি-রপ্তানির মধ্যে ফারাক থেকে যায়।”

তিনি বলেন, “আমাদের আমদানি খরচ কমাতে হবে। পাশাপাশি যদি ৬৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি সম্ভব হয় তাহলে ব্যালান্স অব পেমেন্ট রক্ষা করা সম্ভব হবে এবং আমাদের রিজার্ভের ওপর চাপ পড়বে না।”

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের পহেলা জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশে রপ্তানির পরিমাণ ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এটা ছিল রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার বেশি।

গত অর্থ বছরের বৃদ্ধি মাথায় রেখে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের অর্থাৎ ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত রপ্তানি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৭ বিলিয়ন ডলার।

তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারীদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বুধবার বেনারকে বলেন, “বাণিজ্যমন্ত্রী নতুন রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছেন। লক্ষ্য অর্জিত হোক বা না হোক তা নির্ধারণ করতে হবে, চেষ্টা করতে হবে। সেদিক থেকে বলবো ঠিকই আছে।”

তিনি বলেন, “তবে লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে বেশি কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি-রপ্তানি দুটোই ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। কাঁচামালের দাম বেড়েছে। জাহাজ ও অন্যান্য পরিবহন ভাড়াও বৃদ্ধি পেয়েছে।”

সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “যদি ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয় এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি টালমাটাল থাকে এবং ইউরোপ-আমেরিকার অর্থনীতি ক্ষতির মুখে পড়ে, সেক্ষেত্রে আমাদের রপ্তানিও ক্ষতির মুখে পড়বে।”


বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মনিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বুধবার বেনারকে বলেন, সরকার রপ্তানির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, সেটি গত অর্থ বছরের চেয়ে শতকরা প্রায় ১০ ভাগ বেশি; সেটি হয়তো ঠিকই আছে। তবে এটি অর্জনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

তিনি বলেন, “আমাদের রপ্তানি আইটেমের মধ্যে তৈরি পোশাকই প্রধান। ইতোমধ্যে বিজিএমইএ’র তথ্য অনুসারে দেখা যাচ্ছে, কিছু ক্রেতা ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছেন। এটি ভালো খবর নয়।”

ড. মোস্তাফিজ বলেন, “আমাদের পোশাকের বাজার মূলত আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো। কিছু পশ্চিমা অর্থনীতিবিদ বলছেন, পশ্চিমা দেশগুলোতেও মন্দা দেখা দেবে। সুতরাং, সেখানে মন্দা দেখা দিলে আমাদের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে।”

“তবে আমাদের রপ্তানিকারকরা কিছুটা সুবিধা পাবেন। কাঁচামালের দাম কমে আসলে এই সুবিধা পাবেন তারা,” যোগ করেন তিনি।

ড. মোস্তাফিজ বলেন, “আরেকটি সুবিধা হলো, ডলারের বিপরীতে টাকার বেশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। এর ফলে আমাদের রপ্তানিকারকেরা বেশি সুবিধা পাবেন।”

তিনি বলেন, “সুতরাং, এই পর্যায়ে এখন বলা যাচ্ছে না যে, রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে কি হবে না। তবে বলা যায় সামনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে।”

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিয়মানুযায়ী, রপ্তানিকারক দেশের মূদ্রার মান কম হলে বৈদেশিক মূদ্রা আয় বেশি হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বরাবর অভিযোগ করে আসছে যে, বাড়তি বাণিজ্য সুবিধা পেতে চীন তার মূদ্রাকে অবমূল্যায়িত করে রেখেছে।

চীনের মতো বাংলাদেশে বৈদেশিক মূদ্রা আয় বাড়াতে ব্যবসায়ীরা অনেকদিন ধরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকা অবমূল্যায়নের পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। তবে সরকার সেই পরামর্শ গ্রহণ করছিলেন না। এর অন্যতম কারণ হলো, টাকা অবমূল্যায়িত হলে আমদানি খরচ এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে।

আমদানি নির্ভর বাংলাদেশের আমদানি সবসময়ই রপ্তানির চেয়ে বেশি।

তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ডলারের দাম রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। কয়েকমাস আগেও প্রতি ডলারের বিপরীতে ৮৫ টাকা মিললেও বর্তমানে সেটি ৯৪ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

খোলা বাজারে ডলারের দাম ১০৪ টাকা পর্যন্ত উঠেছে, যা এখন একশ টাকার কাছাকাছি ঘুরপাক খাচ্ছে। দাম ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নিলেও স্বাভাবিক হয়নি ডলারের বাজার।

এ ছাড়া রেকর্ড আমদানি হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।

বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ সংকট সৃষ্টি হলে দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক মূদ্রা না থাকায় দেউলিয়া হয়ে পড়েছে শ্রীলঙ্কা।

এই প্রেক্ষাপটে সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া বিলাসদ্রব্য আমাদানি নিরুৎসাহিত করছে এবং অগ্রাধিকারে না থাকা প্রকল্পগুলো স্থগিত করেছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।