দার্জিলিং পাহাড়ে ১০৪ দিন পর স্বাভাবিক জনজীবন

পরিতোষ পাল
2017.09.27
কলকাতা
দার্জিলিংয়ে বনধ প্রত্যাহারের পর বুধবার সকাল থেকে গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে। দার্জিলিংয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহারের পর বুধবার সকাল থেকে গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
বেনারনিউজ

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং পাহাড়ে জনজীবনে বুধবার সকাল থেকেই স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এসেছে। সুনীল তামাং, প্রেমা লিম্বুরা সকাল থেকেই রাস্তার ধারে পসরা সাজিয়ে বসেছেন। সবজি বাজারে কেনাকাটার জন্য ভিড় জমিয়েছেন স্থানীয় মানুষ। সমতল থেকে আসছে গাড়ি ও বাস। দুপুরের মধ্যেই পর্যটকদের আনাগোনা চোখে পড়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন দার্জিলিংয়ের বাসিন্দা সীমা ছেত্রী। কালিম্পং, কার্শিয়াং ও মিরিকেও স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে এসেছে।

উৎসব থাকায় প্রথম সুযোগেই অনেকে ভিড় করেছেন পোশাকের দোকানে। খুলেছে স্কুল কলেজ, অফিস, আদালতও। রেস্টুরেন্ট ও হোটেলগুলি খোলার তোড়জোড় শুরু হয়েছে বলে জানান পর্যটন ব্যবসায়ী সম্রাট সেন।

মাসাধিককাল শিলিগুড়িতে আত্মীয়দের বাড়িতে কাটিয়ে সপরিবারে কালিম্পং ফিরে যাচ্ছেন মদন ছেত্রী। তিনি বেনারকে বলেন, “বন্ধের ফলে এতটাই সংকটে ছিলাম যে, সমতলে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এবার আবার ফিরে যাচ্ছি। গিয়েই দোকান খুলব।”

মদন ছেত্রীর মতো আরও অনেকেই বুধবার সকালে ভিড় করেছেন শিলিগুড়িতে গাড়ির স্ট্যান্ডে। কেউ ফিরে যাচ্ছেন কার্শিয়াংয়ে, কেউবা দার্জিলিংয়ে।

দীর্ঘ ১০৪ দিন ধরে চলা এই বন্ধের ফলে পাহাড়ের মানুষের মুখের হাসি উধাও হয়ে গিয়েছিল। সেই হাসি ফের ফিরে এসেছে। বিপর্যন্ত অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছেন তারা, জানালেন নির্মল ছেত্রী।

সোমবার গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার বহিষ্কৃত নেতা বিনয় তামাংয়ের নেতৃত্বে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাজ শুরু করার পরেই পাহাড়ের পরিবেশ পাল্টাতে শুরু করেছিল। আর সোমবার রাত থেকে ইন্টারনেট পরিষেবা চালু হওয়ার ফলে মঙ্গলবার থেকে ব্যাংক ও এটিএমও স্বাভাবিক কাজ শুরু করে। দার্জিলিংয়ের জেলা শাসক জয়শ্রী দাশ গুপ্ত এই খবর জানিয়ে বলেছেন, দার্জিলিং ও কালিম্পংয়ে নেট পরিষেবা পুনরায় চালু করা হয়েছে।

তবে ২৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এক বিবৃতিতে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ও তার প্রেসিডেন্ট বিমল গুরংয়ের উদ্দেশ্যে বন্ধ তুলে নেবার আবেদন জানানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অজ্ঞাতস্থান থেকে এক অডিও বার্তায় বন্ধ প্রত্যাহারের কথা জানানো হয়। মোর্চার সহকারী সম্পাদক জ্যোতি রাই বলেন, রাজনাথ সিংয়ের আবেদনের পর বিমল গুরুংসহ দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই বন্ধ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

অবশ্য মোর্চার বহিষ্কৃত নেতা ও জিটিএ-র ভাইস চেয়ারম্যান অনীত থাপা বেনারকে বলেন, বন্ধ প্রত্যাহারের ঘোষণা যদি নাও আসত, পাহাড়ের মানুষ নিজেরাই তা তুলে নিতেন।

পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মন্ত্রী গৌতম দেবও বেনারকে বলেন, পাহাড়ের মানুষ নিজেরাই যখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন তখন এই অনুরোধ ও ঘোষণা অর্থহীন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ধরনা

গোর্খাল্যান্ডের দাবিসহ বিভিন্ন দাবিতে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক ডাকার জন্য মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরির নেতৃত্বে গুরুংপন্থী কয়েকজন নেতা নয়াদিল্লিতে ধরনা দিয়ে বসেছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এই নেতারা দার্জিলিংয়ের বিজেপি বিধায়ক সুরিন্দর সিং আলুআলিয়ার মধ্যস্থতায় তিনবার বৈঠক করেছেন। গত ১৯ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে মোর্চা নেতারা ত্রিপক্ষীয় বৈঠক ডাকার ওপর জোর দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন প্রতিনিধিদলের এক সদস্য।

প্রথমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোর্চা নেতাদের রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দিলেও ২৬ সেপ্টেম্বর রাজনাথ সিং এক বিবৃতিতে জানান, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব রাজীব গাউবাকে তিনি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার দাবিসমূহ নিয়ে আলোচনার জন্য ১৫ দিনের মধ্যে বৈঠক ডাকার নির্দেশ দিযেছেন।

বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, “গণতন্ত্রে আলোচনাই সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। আইনের চৌহদ্দির মধ্যে সংযম, পারস্পরিক মতামত আদানপ্রদানের মধ্যেই সমাধান বেরিয়ে আসে।”

অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পাহাড়ের দলগুলির সঙ্গে দু দুবার (২৯ অক্টোবর ও ১২ সেপ্টেম্বর) বৈঠক করলেও কোনো সমাধানে পৌঁছানো যায়নি। তিনি স্পষ্ট করেই পাহাড়ের নেতাদের জানিয়ে দেন যে, গোর্খাল্যান্ড নিয়ে আলোচনা করার তাঁর কোনো এখতিয়ার নেই। তবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আগামী ১৬ অক্টোবর তৃতীয় বৈঠকে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার কথা জানাবেন । সেই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী পাহাড় সমস্যার স্থায়ী সমাধানের ওপর গুরুত্ব দেন।

বন্ধ এর শুরু

গত মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের সব বিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলা ভাষা পড়ানোর ঘোষণা দিলে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতারা তা না মেনে এর বিরোধিতায় মাঠে নামেন এবং মুখ্যমন্ত্রীর ওই ঘোষণা প্রত্যাহারের দাবি জানান। ৮ জুন দার্জিলিংয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক করতে এসে মুখ্যমন্ত্রী এই ঘোষণা নেপালিদের জন্য প্রযোজ্য নয় বলে জানানো সত্ত্বেও গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতারা আন্দোলন শুরু করেন। ১৫ জুন থেকে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের পুরোনো দাবিতে শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ।

গত তিনমাসের বেশি সময় ধরে চলা বন্ধে আন্দোলনের নামে পাহাড়ে ব্যাপক অশান্তি ও হিংসার ঘটনা ঘটেছে। বহু সরকারি সম্পত্তি, বাংলো ও গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। দার্জিলিং, কালিম্পং ও সুখিয়া পুখরিতে আইইডি ও গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

এই আন্দোলনের জেরে ১১টি অমূল্য জীবন এ পর্যন্ত নষ্ট হয়েছে, সাতজন জখম হয়েছেন, গোটা দার্জিলিংয়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে রাজনাথ সিং বিবৃতিতে জানিয়েছেন। বন্ধের ফলে দার্জিলিংয়ের ৮৪টি চা বাগান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে পর পর তিন মাস চায়ের নিলামে দার্জিলিংয়ের চায়ের জায়গা হয়নি।

ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাস বেনারকে বলেন, তিন মাসের এই বন্ধের ফলে পাহাড়ের চা, পর্যটন সহ নানা ক্ষেত্র মিলিয়ে কমপক্ষে ৪০০ কোটি রুপি ক্ষতি হয়েছে। রাজ্য সরকার অবশ্য দাবি করেছে, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস সহ মোট ক্ষতির পরিমাণ ৬০০ কোট রুপির।

মোর্চায় ফাটল

ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়া সত্ত্বেও কট্টরপন্থীদের হুমকির মুখে বন্ধ তোলা যাচ্ছিল না । আর তাই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে মোর্চার প্রতিনিধি হিসেবে বিনয় তামাং ও অনীত থাপারা আলোচনা করে দার্জিলিং ফিরে বন্ধ প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও গুরুংপন্থীরা পাল্টা হুমকি দিয়ে বন্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। মোর্চার মধ্যে তৈরি হয় ফাটল। সেই ফাটলকে বাড়িয়ে দিয়ে ১ সেপ্টেম্বর বিনয় তামাং ও অনীত থাপাকে মোর্চা থেকে বহিষ্কার করে দেন প্রেসিডেন্ট বিমল গুরুং।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিনয় তামাংদেরই মোর্চার প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নেয়। আর তাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাহাড়ের পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে ২০ সেপ্টেম্বর বিনয় তামাংকে চেয়ারম্যান এবং অনীত থাপাকে ভাইস চেয়ারম্যান করে জিটিএ-র পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে ৮ সদস্যের বোর্ড গঠন করেন। গত সোমবারই এই বোর্ড কাজ শুরু করেছে।

রাজ্য সরকারের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, বিমল গুরুংসহ মোর্চার শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন আইনে মামলা রয়েছে। জারি করা হয়েছে লুকআউট নোটিশও। ফলে গুরুংসহ অনেক শীর্ষ নেতাই বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন এমন তিন মোর্চা নেতাকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সিআইডি হরিয়ানা থেকে গ্রেপ্তারও করেছে। বাকিদের ধরার জন্য জোরদার অভিযান চলছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন দার্জিলিংয়ের পুলিশ সুপার অখিলেশ চতুর্বেদী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।