তাপে পুড়ছে বাংলাদেশ
2024.04.23
ঢাকা
বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরামের পরিসংখ্যান অনুসারে, গত ১৯ থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ১৬ ব্যক্তি হিট স্ট্রোকের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন, যাদের অধিকাংশই মারা গেছেন নিজ কর্মস্থলে।
মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকায় একজন পথচারী, ঢাকার বাইরে পটুয়াখালীতে এক পুলিশ কনস্টেবল, কুমিল্লায় একজন নির্মাণ শ্রমিক ও নাটোরে একজন কৃষক হিট স্ট্রোকের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। এই চারটি মৃত্যু যোগ করলে গত পাঁচ দিনে দেশে হিট স্ট্রোকের উপসর্গ নিয়ে ২০ জনের মৃত্যু হলো।
এদিন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর গুলিস্তান টোল প্লাজায় গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে যাওয়ার সময় জ্ঞান হারিয়ে সড়কে পড়ে যান প্রিন্টিং প্রেসের কর্মচারী আলমগীর সিকদার (৫৬)।
পথচারীরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বেনারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে চিকিৎসকরা হিট স্ট্রোকের উপসর্গ পেয়েছেন।”
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (শেবাচিম) পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম বেনারকে জানিয়েছেন, পটুয়াখালী থেকে পুলিশের একজন কনস্টেবলকে মঙ্গলবার এই হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। তিনি মারা গেছেন।
“প্রাথমিকভাবে আমাদের চিকিৎসকরা ধারণা করছেন, ওই পুলিশ সদস্য হিট স্ট্রোকে মারা গিয়ে থাকতে পারেন,” বলেন তিনি।
স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, ঢাকায় পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) কর্মরত ওই পুলিশ সদস্য মোহাম্মদ শাহ-আলম (৫০) ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন।
দুর্যোগ ফোরামের সমন্বয়ক মেহেরুন্নেসা বেনারকে বলেন, “হিট স্ট্রোকের উপসর্গ নিয়ে যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই শ্রমজীবী নিম্ন আয়ের মানুষ; যেমন রিকশাচালক ও কৃষক বা কৃষি কাজে সম্পৃক্ত ব্যক্তি।”
তিনি বলেন, “মৃত্যুর ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, মাঠে কৃষি কাজের সময়, রাস্তায় চলাচলের সময় এবং খোলা আকাশের নিচে কাজ করতে হয় এমন ব্যক্তিরাই বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন।”
রোগী বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে
চলমান তাপপ্রবাহে হাসপাতালগুলোতে গরমজনিত নানা রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, শিশুরা নিউমোনিয়া, হাঁপানি, ডায়রিয়া ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছে।
বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, অনেক অভিভাবক তাঁদের বাচ্চাদের নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে আসছেন।
ঢাকার মুগদা এলাকার গৃহবধূ সেলিনা বেগম সোমবার সকালে তাঁর ১৮ মাস বয়সী শিশুকে নিয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউটে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।
“আমার মেয়ে জ্বর ও ডায়রিয়ায় ভুগছে। এখন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব,” বেনারকে বলেন সেলিনা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, গত ১০ থেকে ২০ এপ্রিলের মধ্যে মোট এক হাজার ৮৬৯ শিশু হাসপাতালে গেছে, যাদের মধ্যে ১৪৩ জনকে ভর্তি করতে হয়েছে।
হাসপাতালে আসা শিশুদের অধিকাংশই নিউমোনিয়া আক্রান্ত বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম ইনচার্জ এম কে হাসান জাহিদ।
তিনি বেনারকে বলেন, “গরমের তীব্রতার ফলে স্বাভাবিকের তুলনায় রোগীর চাপ এখন বেশি।”
ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম বেনারকে বলেন, গ্রীষ্মের মৌসুম শুরু হওয়ার পরপরই হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়তে শুরু করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বেনারকে বলেন, “দেশের সকল হাসপাতালকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে, যাতে যে কোনো পরিস্থিতিতে নাগরিকদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা যায়।”
তিনি বলেন, “চলমান পরিস্থিতিতে মানুষের উচিত হবে খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাইরে না যাওয়া এবং যতটা সম্ভব নিজেদেরকে রোদ থেকে বাঁচিয়ে রাখা।”
গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিট অ্যালার্ট
দেশে চলমান গরমের তীব্রতায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাত দিনের জন্য ছুটি দিয়েছে সরকার। মূলত ঈদের ছুটি শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আর না খুলে, আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি বাড়িয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শনিবার মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এদিকে সোমবার থেকে আরও তিন দিনের জন্য দেশজুড়ে ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। নাগরিকদের বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাইরে না যেতে অনুরোধ করা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, “আগামী দুই দিন আবার তাপমাত্রা বাড়তে পারে। তাই সতর্কবার্তার সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।”
পরিবেশের ওপর আঘাতে বাড়ছে তাপমাত্রা
মঙ্গলবার আবহাওয়া অধিদপ্তর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে যশোরে ৪০ দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিন ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়াবিদ বজলুর জানান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ১৯৬০ সালে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল সেই বছরের ৩০ এপ্রিল ৪২ দশমিক তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এরপর ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড হয় ৫৪ বছর পর ২০১৪ সালের ১৪ ও ২৩ এপ্রিল। একই তাপমাত্রা আবার রেকর্ড করা হয় গত বছরের ১৪ এপ্রিল। এ বছর ২০ এপ্রিল ঢাকায় তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৪০ দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বেনারকে বলেন, ঢাকায় তাপমাত্রা বাড়া এবং তা অসহ্য রকমের হয়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে পরিবেশের ওপর আঘাত।
তিনি বলেন, “স্থানীয়ভাবে যেসব কারণে তাপমাত্রা বাড়ে, তার মধ্যে অন্যতম হলো ঢাকা শহরের সবুজায়ন কমে যাওয়া। এক সময় বাংলাদেশে ২৫ ভাগের বেশি সবুজায়ন থাকলেও বর্তমানে এর পরিমাণ খুবই নগণ্য।”
তিনি বলেন, “এখন শহরের সৌন্দর্য বর্ধনের নামে রাস্তার বিভাজনের বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। ফলে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ও জলীয়বাষ্প কমে গিয়ে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং একই কারণে বৃষ্টিপাতও কমছে।”
দ্বিতীয় অন্যতম কারণ জলাধার কমে যাওয়া উল্লেখ করে তিনি বলেন, “গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, ঢাকা শহরের জলাধার বা পুকুরের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। জলাধার মাটির পরিবর্তে বালি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। এটিও তাপমাত্রা বাড়ার অন্যতম কারণ।”
তিনি বলেন, “ঢাকা শহরের ৩৬টি স্থান নিয়ে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) পরিচালিত গবেষণায় উঠে এসেছে, যেসব এলাকায় সবুজের উপস্থিতি রয়েছে, সেসব এলাকায় তাপমাত্রা তুলনামূলক কম।
বজলুর বলেন, “সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে দুই থেকে তিন বার বৃষ্টি হয়ে থাকে কিন্তু এ বছর এটির ব্যতিক্রম ঘটেছে।”