আহমদ শফীর মৃত্যু: হেফাজতে ইসলামে নেতৃত্বের লড়াই
2020.09.21
ঢাকা
আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুতে রক্ষণশীল ইসলামী গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব নিয়ে দুটি পক্ষ তৈরি হয়েছে। এর একদিকে রয়েছেন সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত শফিপূত্র আনাস মাদানী এবং অন্যদিকে আছেন বিএনপি-জামায়াতপন্থী সমর্থক বলে পরিচিত জুনাইদ বাবুনগরী, যাঁকে গত জুনে নেতৃত্বের বাইরে পাঠানো হয়।
হেফাজতে ইসলাম বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী গোষ্ঠী, যারা বর্তমান সরকারের সমর্থক বলে পরিচিতি পেয়েছে। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, দেশের প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী কওমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। যদিও কওমি মাদ্রাসার পক্ষ থেকে বলা হয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৭ লাখের কম নয়।
ছাত্র বিক্ষোভের মুখে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতারিম (মহাপরিচালক) পদ থেকে পদত্যাগের ১২ ঘন্টার মাথায় গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ইন্তেকাল করেন হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী (১০৩)। লাখো মানুষ তাঁর জানাজায় অংশ নেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শফী বিরোধী বিক্ষোভ ও মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর পূত্র ও হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক আনাস মাদানী এবং জুনায়েদ বাবুনগরীর মধ্যকার নেতৃত্বের বিরোধ চাঙ্গা হয়েছে। এর ফলে হেফাজতের নেতৃত্বে ফাটল ধরতে পারে এবং নেতা-কর্মীদের ওপর এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বেনারকে বলেন, “সরকারের সাথে সমঝোতা করা নিয়েই শফী ও বাবুনগরীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। শফীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হেফাজতের নেতৃত্বে একটা বড় শূন্যতা তৈরি হলো।”
“সরকার চেষ্টা করবে হেফাজতের উপর প্রভাব ধরে রাখতে। অন্যদিকে জামায়াতও একই চেষ্টা করবে,” বলেন তিনি।
শফীর নেতৃত্বে হেফাজত কাউন্সিল গত জুনে জুনাইদ আহমেদ বাবুনগরীকে হাটহাজারী মাদ্রাসার সহযোগী পরিচালকের (মুঈনে মুহতামিম) পদ থেকে সরিয়ে দেয়। গত বুধবার হাটহাজারী মাদ্রাসায় আহমদ শফী ও তার পুত্র আনাস মাদানির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়।
বিক্ষোভকারীরা শফীর কক্ষ ভাংচুর করে। ওই দিন মধ্যরাতের বৈঠকে তাঁকে ও তাঁর ছেলেকে মাদ্রাসার নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। শফী মাদ্রাসার মহাপরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন, পরদিন শুক্রবার অসুস্থ হয়ে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
“আহমেদ শফী বেশিরভাগ হেফাজত অনুসারীর কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা ছিলেন। তিনি নিজ পূত্র আনাস মাদানিকে তাঁর উত্তরসূরি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাবুনগরী হাটহাজারী মাদ্রাসা ও হেফাজতে ইসলামের প্রধান হতে চেয়েছিলেন। এ জন্য বাবুনগরীকে মাদ্রাসা পরিচালনার নেতৃত্ব থেকে বহিষ্কার করা হয়,” বেনার নিউজকে বলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, “আহমদ শফী আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন, এর ফলে সরকার আইন প্রণয়ন করে কওমি মাদ্রাসার সনদকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমান দিয়েছে।”
সনদের স্বীকৃতি দেওয়ায় কওমি মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষক হেফাজতের পক্ষ থেকে বিরাট সংবর্ধনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল।
“সম্ভবত বাবুনগরী হেফাজতের শফী বিরোধী নেতাদের একত্রিত করেছিলেন। তাই হাটহাজারী মাদ্রাসার ভিতরে শফী-বিরোধী গোষ্ঠী প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিল। এরই জের ধরে পিতা-পূত্র পদত্যাগ করেন,” বলেন ড. নিজামউদ্দীন আহমেদ।
আহমদ শফিকে দাফন করার পরে হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটি বাবুনগরীকে শিক্ষা সচিব হিসাবে নিয়োগ দেয় বলে বেনারকে জানিয়েছেন মাদ্রাসার অন্যতম শূরা সদস্য সালাউদ্দিন নানুপুরী।
তিনি বলেন, “বাবুনগরী আবার মাদ্রাসায় ফিরে এসেছে। তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসা ও হেফাজতে ইসলামের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একজন।”
“আনাস মাদানীকে মাদ্রাসার সহকারী পরিচালকের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি হেফাজতে ইসলামের সাথে রয়েছেন,” বলেন তিনি।
সালাউদ্দিন নানুপুরী বলেন, “হেফাজতে ইসলামের নতুন নেতা নির্বাচনের জন্য আমরা এক মাসের মধ্যে বৈঠক করব। মাদ্রাসা পরিচালনায় তিন সসদ্যের কমিটি হয়েছে। তাঁরা হলেন; মুফতি আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ আহমদ ও মাওলানা মো. ইয়াহিয়া।
ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ বেনারকে বলেন, “শফীর মৃত্যুর পরে বাবুনগরী হেফাজতে ইসলামের প্রধান হতে চাইবেন। তবে শফীপন্থীরা তাঁকে সেটা হতে দেবে না।”
“সুতরাং, আমি মনে করি হেফাজত দুটি গ্রুপে বিভক্ত হতে পারে; একটি আনাস মাদানির নেতৃত্বে এবং অন্যটি বাবুনগরীর নেতৃত্বে,” বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শান্তনু মজুমদার বেনারকে বলেন, “২০১০ সালে হেফাজতে ইসলাম গঠনের আগে আহমদ শফীকে কেউ খুব একটা চিনত না। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সহিংস সমাবেশের মাধ্যমে জনগণ হেফাজতে ইসলাম এবং আহমেদ শফী সম্পর্কে জানতে পারে।”
“ওই সহিংস সমাবেশ শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করার পর থেকেই সরকার হেফাজতের প্রতি নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করে আসছে," বলেন শান্তনু মাজুমদার।
“সংগঠনের মধ্যে বাবুনগরীর শক্ত অবস্থান রয়েছে। তবে শফীর জানাজায় বিপুল সংখ্যক লোকের উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে, তাঁর নাম হেফাজতে ইসলাম থেকে মুছে যাবে না,” বলছিলেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
“গত বেশ কয়েকদিনের ঘটনাবলি ইঙ্গিত দেয় যে, হেফাজতে সরকার বিরোধীরা যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে এই প্রবণতা কত দিন থাকবে তা অনুমান করা কঠিন,” ড. মজুমদার বলেন।
“সম্ভবত, আগামী দিনে হেফাজতের ওপর কর্তৃত্বের লড়াই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠবে। শফী পরবর্তী হেফাজতের ভবিষ্যৎ এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত, দলটি ভেঙে গেলেও অবাক হবো না,” বলেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান বেনারকে বলেন, “শফীপন্থী বা বাবুনগরী গ্রুপ হেফাজতে ইসলামকে প্রভাবিত করবে কিনা, তা এখনই বলা কঠিন। আওয়ামী লীগ সরকার কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই আমরা আশা করি হেফাজতের পরবর্তী নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ সরকারের অবদান মনে রাখবে।”