মুক্তি পেয়ে রসরাজের এখন নিরাপত্তার আশঙ্কা

ঢাকা থেকে পুলক ঘটক
2017.01.17
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর রসরাজ দাস। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর রসরাজ দাস। জানুয়ারি ১৭, ২০১৭।
স্টার মেইল

ধর্ম অবমাননাকর কথিত ছবি পোস্ট করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া রসরাজ দাস (৩০) প্রায় আড়াই মাস পর জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ফেসবুকে ওই ছবি পোস্ট করাকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে গত বছরের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরে মন্দির ও হিন্দুদের বেশ কয়েকটি বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পরে আরও কয়েক দফায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সাম্প্রদায়িক হামলার ওই ঘটনায় আটটি মামলায় ১০৬ জন গ্রেপ্তার রয়েছেন।

গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কারাগার থেকে ছাড়া পান রসরাজ। ছাড়া পেয়ে নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে উপস্থিত সাংবাদিকদের রসরাজ দাস বলেন, “আমি আমার জীবন লইয়া চিন্তায় আছি। হুনছি যে, জেল থেইক্যা ছাড়া পাইয়া এলাকায় গেলে নাকি লোকজন আমারে মাইরধর করব।”

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলায় বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নভেম্বর ৫, ২০১৬।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলায় বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নভেম্বর ৫, ২০১৬।
ফোকাস বাংলা
প্রশাসন ও পুলিশের কাছে নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান রসরাজ। তিনি আরও বলেন, “আমি ফেসবুক চালাইতে জানি না। পাসওয়ার্ড বুঝি না। আমার একটা টাচ মোবাইল আছিল। হেইডা দিয়া ফেসবুক চালাইতাম। আর ছবি দেখতাম।”

ফেসবুক কে খুলে দিয়েছে জানতে চাইলে রসরাজ বলেন, ঘটনার মাস তিনেক আগে চাচাতো ভাই হৃদয় ফেসবুকে আইডি খুলে দিয়েছিল। রসরাজ আরও জানান, ফেসবুকে পোস্ট হওয়া ধর্মীয় অবমাননাকর সেই ছবিটি তিনি এখনো দেখেননি। তিনি আরও বলেন, “আমি নির্দোষ। এসব আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।”

গত সোমবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাইল হোসেনের আদালতে রসরাজের উপস্থিতিতে জামিন শুনানি হয়। মামলার আইনজীবী মো. নাসির মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, “আদালত ১০ হাজার টাকার বন্ডের শর্তে তাঁর অস্থায়ী জামিন মঞ্জুর করেন।”

মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ এম ইউসুফ বেনার নিউজকে বলেছেন, সরকারের তদন্তে ছবি পোস্ট করার সঙ্গে রসরাজের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

রসরাজ নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণের বেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে।
তাঁর মামা ইন্দ্রজিৎ দাস সাংবাদিকদের বলেন, গ্রামে গিয়ে আমরা এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথা বলেই রসরাজের বাড়িতে থাকা না থাকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইন অবশ্য সাংবাদিকদের বলেন, রসরাজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। নাসিরনগর উপজেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক বলে মনে করেন তিনি।

গত ২৮ অক্টোবর রসরাজের ফেসবুক আইডি থেকে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে একটি ছবি পোস্ট করা হয়। ওই ঘটনায় পরের দিন হরিণের বেড় গ্রাম থেকে রসরাজকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত ২৯ অক্টোবর নাসিরনগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কাউসার হোসেন বাদী হয়ে রসরাজের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ (২) ধারার মামলা দায়ের করেন।

পরে রসরাজকে আদালতের মাধ্যমে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। তবে রসরাজ দাসের মুঠোফোন ও মেমোরি কার্ডে নমুনা ছবির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ওই প্রতিবেদন উল্লেখ করেছে।

রসরাজ পেশায় একজন জেলে। লেখাপড়া পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। স্বল্প শিক্ষিত এই লোকটি ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে ইসলাম অবমাননা করেছেন এই অভিযোগে পরদিন ৩০ অক্টোবর নাসিরনগর সদরে কয়েক হাজার মানুষের বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

সমাবেশ থেকে কয়েকশ মানুষ হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে সংঘবদ্ধ হামলা চালায়। তারা ১৫টি মন্দিরসহ হিন্দুদের শতাধিক ঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বেনার নিউজকে বলেন, “রসরাজ নির্দোষ এ রকম সুস্পষ্ট তথ্য প্রমাণ থাকার পর তার জামিন এত দেরিতে হওয়া দুঃখজনক। নিরীহ মানুষ হয়রানি হবে আর দোষী ব্যক্তিরা পার পেয়ে যাবে এ রকম সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া উচিত। রসরাজের মতো যারা অন্যায়ভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন তাদের জন্য রাষ্ট্রের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা উচিত।”

হাঁটা চলা করতে দেওয়া হয়নি

জেলের ভেতর হাঁটাচলা করতে দেওয়া হয়নি রসরাজকে। একটি সেলে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। কারাবন্দী জীবনের দিনগুলোর কথা তুলে ধরে রসরাজ বলেন, “জেলখানার ভেতর অন্যরা বেড়ালেও আমাকে আলাদা একটি সেলে বন্দী অবস্থায় রাখা হয়েছিল। কারও সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হতো না। ২৪ ঘণ্টা একটি সেলের মধ্যে রাখা হতো।”

এ ব্যাপারে জেল সুপার নুরুন্নবী বেনার নিউজকে বলেন, “রসরাজের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তাকে আলাদা সেলে রাখা হয়েছিল।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।