বাংলাদেশের সংখ্যালঘু চিত্র: তিন দশক পর দেশে হিন্দু না থাকার আশঙ্কা গবেষকদের

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.11.30
সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদ সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিভিন্ন সংগঠনের মানববন্ধন। নভেম্বর ১১, ২০১৬।
স্টার মেইল

স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম আদমশুমারিতে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ছিল ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ, যা এখন কমে হয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। গবেষকেরা বলছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৩০ বছর পর বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।

২০০১ ও ২০১১ সালের আদমশুমারির পরিসংখ্যান তুলনা করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) বলছে, গত ১০ বছরে কমপক্ষে নয় লাখ হিন্দু দেশ ত্যাগ করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত তাঁর ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি অফ রিফরমিং এগ্রিকালচার-ল্যান্ড-ওয়াটার বডিস ইন বাংলাদেশ’ বইতে বলছেন, প্রতিদিন গড়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ৬৩২ জন দেশ ছাড়ছেন। তাঁর মতে, এ অবস্থা চলতে থাকলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অস্তিত্ব তিন দশক পর আর থাকবে না।

স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা কমলেও বেড়েছে মুসলমানদের সংখ্যা। স্বাধীনতার পর ৮৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০০১ সালের আদমশুমারিতে মুসলমানদের সংখ্যা ৮৯ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত হয়। এখন এই হার প্রায় ৯০ শতাংশ।

আদমশুমারি কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন বিবিএসের এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেশের কমপক্ষে ১৫ টি জেলায় হিন্দুদের সংখ্যা কমেছে। তাঁরা নিজ জেলা ছেড়ে অন্য কোথাও গেছেন এমন কোনো প্রমাণ নেই। এঁদেরকে বলা হচ্ছে ‘মিসিং পপুলেশন’।

নিপোর্টের গবেষণা পরিচালক রফিকুল ইসলাম সরকার গত রোববার বেনারকে বলেন, “হিন্দু পরিবারগুলোয় জন্মহার কম, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের হার বেশি। তবে সবচেয়ে বড় কারণ অভিবাসন।”

বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, একসময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাধিক্য ছিল যেসব জেলায় সেই গোপালগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ঠাকুরগাঁও, খুলনা, দিনাজপুর ও বাগেরহাটে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কমে গেছে। একমাত্র নড়াইল ছাড়া অন্য সব জেলায় ১৯৯১ সালের পর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কমেছে।

বাগেরহাটের বেমরতা গ্রামের বাসিন্দা খান কামরুল ইসলাম (৪৯) বেনারকে বলেন, তাঁদের ওই গ্রামটিতে মুসলমানদের চেয়ে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল বেশি। গত দুই দশকের ব্যবধানে এখন সেখানে উল্টো অবস্থা বিরাজ করছে।

আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসেবে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হিন্দুদের ১৬৮ টি বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং ১৩০ টি পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ছাড়া ৫ জনের জমি ও বসতবাড়ি দখল করা হয়েছে, বিভিন্ন ঘটনায় ৪৯ জন হিন্দু আহত হয়েছেন, সাতজন মারা গেছেন।

গবেষক, ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো বলছে, যে কোনো ছুতোয় জমি দখলের ইচ্ছে থেকে প্রভাবশালীরা হিন্দুদের ওপর হামলা করছেন। প্রশাসন ও সরকারদলীয় লোকজনের কাছ থেকে যথেষ্ট সহায়তা না পেয়ে বা আস্থা রাখতে না পেরে তাঁরা দেশ ছাড়ছেন।

১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদে এ দেশীয় হিন্দুদের ওপর হামলা হয়েছে। ২০০১ সালে নির্বাচনের পর বিএনপি জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর নির্বিচারে ধর্ষণ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। আস্থাহীনতা থেকে সে সময় বড় সংখ্যায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী দেশে ছেড়েছেন।

ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগের জ্যেষ্ঠ গবেষক মোহাম্মদ রফি। নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা নিয়ে লেখা গবেষণাগ্রন্থে তিনি বলেন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রতিবাদ না জানিয়ে দেশ ছাড়ে বলে সম্পত্তি দখলের জন্য তাদের ভয়ভীতি দেখানোর চেষ্টা হয়। সরকার সংখ্যালঘুদের দেশ ছেড়ে যাওয়া বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেয় না। বরং কিছুটা নির্বিকার আচরণ করে।

ওই গ্রন্থে রাফি বেশ কিছু পরিসংখ্যান দিয়েছেন। ২০০১ সালে নির্বাচনের মাস অক্টোবর থেকে ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১২০টি উপজেলায় সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে, হিন্দুদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে বাধা দেওয়া হয়েছে। ১৯০টি উপজেলায় এরা চাঁদাবাজির শিকার হয়েছে। ১৩৭টি উপজেলায় সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। ১২৮টি উপজেলায় সহায়সম্পদ লুটের ঘটনা ঘটে। ১৬২টি উপজেলায় সম্পত্তি ধ্বংস হয় এবং ২০২টি উপজেলায় হিন্দুরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর আরও এক দফা হামলা চলে ঠাকুরগাঁও, নেত্রকোনা, শেরপুর, ময়মনসিংহ, যশোর, দিনাজপুর, লালমনিরহাট ও লক্ষ্মীপুরে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বেনারকে বলেন, “রক্ষণশীল হিসেবে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে শাসকশ্রেণি ও তাঁদের প্রতিনিধিরা জমিজমা দখলের আশায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলায় ইন্ধন জোগান এবং পৃষ্ঠপোষকতা করেন।”

সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হামলার ঘটনায় জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা অগ্রহণযোগ্য ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এএলআরডি এ বছরের শুরুর দিকে দিনাজপুরে খাস জমিতে থেকে ৪০টি হতদরিদ্র হিন্দু পরিবারকে উচ্ছেদ চেষ্টার অভিযোগে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তারা সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, শুধু জমি দখলের জন্য ওই এলাকার সরকার দলীয় নেতা হিন্দুদের হুমকি, মারধর ও মামলা করেছে।

চলতি বছর জুড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বিচারে হামলার খবর বারবার এসেছে গণমাধ্যমে। উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিল; পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে যজ্ঞেশ্বর রায় হত্যা, সাতক্ষীরার আশাশুনিতে ১০০ হিন্দু পরিবারকে গ্রামছাড়া করা, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ৭০ বছরের সাধু পরমানন্দ খুন, কক্সবাজারে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙচুর, ঝিনাইদহে হিন্দু পুরোহিত হত্যা, পাবনায় আশ্রমের সেবায়েৎকে হত্যা, মাদারিপুরে কলেজশিক্ষককে হত্যা চেষ্টা, যশোরে সেবায়েতের লাশ উদ্ধার, গাজীপুরে পুরোহিতকে খুনের চেষ্টা, বগুড়ায় পুরোহিত হত্যা, সাতক্ষীরা, কিশোরগঞ্জ ও রংপুরে হত্যার হুমকি ও ঢাকায় রামকৃষ্ণ মিশনে ধর্মপ্রচারে বাধা দেওয়ার ঘটনা।

সাবেক মন্ত্রী এবং আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বেনারকে বলেন, এ সব ঘটনা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও আস্থার সংকট সৃষ্টি করে। তিনি বলেন, এ দেশে সংখ্যালঘুদের বিতাড়নে ঐক্যবদ্ধ মনোভাব লক্ষ করা গেছে। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, সংখ্যালঘু বিতাড়নে এখানে প্রবল ঐকমত্য আছে।

তিনি বলেন, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে, এর সর্বশেষ উদাহরণ নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা।

বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০১ সাল পরবর্তী ১৩ বছরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২০ হাজারেরও বেশি।

আইন ও সালিস কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “সরকার নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। সংখ্যালঘুদের অনেকেই তাই নির্যাতিত হয়ে প্রাণভয়ে দেশ ছাড়ছেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।