ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংখ্যালঘু নিপীড়ন: নির্দোষ রসরাজের মুক্তি দাবি
2016.12.02

স্থানীয় আদালতে জামিন পাননি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের যুবক রসরাজ দাস (৩০)।ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল শুক্রবার ওই যুবকের মা–বাবা, ভাইসহ স্বজনেরা তাঁর মুক্তির দাবিতে ঢাকায় এসে সংবাদ সম্মেলন করেন।
বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ মনে করেন, গত এক মাস ধরে জেলে থাকা রসরাজের জামিন পাওয়া উচিত। এর কারণ ইসলাম ধর্ম অবমাননার যে ছবি ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে, সেটি যে তিনি করেননি—এটা মোটামুটি প্রমাণিত হয়ে গেছে।
ওই যুবকের মা নমিতা রানি দাস শুক্রবার ছেলেকে ‘নির্দোষ’ দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, লেখাপড়া না জানা রসরাজের পক্ষে ফেইস বুকে কিছু লেখা সম্ভব না।
অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশও ইতোমধ্যে জানিয়েছে, রসরাজের মোবাইল ফোন থেকে এই ছবি পোস্ট করা হয়নি। তা ছাড়া ছবিটি পোস্ট করার দিন তিনি মাছ ধরতে গিয়েছিলেন বলে সাক্ষ্যপ্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।
ফেইসবুকে ‘ধর্মীয় অবমাননার’ অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের এই জেলেকে গত ২৯ অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হয়। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঁচ দিনের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এর একদিন পর ওই ছবি পোস্ট করাকে কেন্দ্র করে ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরে ১৫টি মন্দির ও হিন্দুদের শতাধিক বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এ ঘটনার আগে সেখানে ইসলামি দুটি সংগঠন বিক্ষোভ–সমাবেশ করে।
গত ২৮ নভেম্বর জেলা পুলিশের কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে রসরাজের ব্যবহৃত মুঠোফোন থেকে ইসলাম ধর্ম অবমাননাকর সেই কথিত ছবি ফেসবুকে পোস্ট করা হয়নি বলে উল্লেখ করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ফরেনসিক বিভাগ। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইনও স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন।
অন্যদিকে পুলিশ জাহাঙ্গীর আলম (৩০) নামে স্থানীয় এক সাইবার ক্যাফের মালিককে ওই ছবি পোস্ট করার অভিযোগে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশের ধারণা ওই ছবিটি জাহাঙ্গীরই পোস্ট করেছে।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার রসরাজ দাসের মুঠোফোনের ফরেনসিক প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত রসরাজের জামিনের বিষয়ে আংশিক শুনানি শেষে পুলিশকে এ নির্দেশ দেন। আদালত এক মাস পর আগামী ৩ জানুয়ারি শুনানির পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন।
“আমরা আদালতে বলেছি যে, রসরাজ তাঁর মুঠোফোন থেকে এ ধরনের ছবি পোস্ট করেননি। পুলিশ ইতিমধ্যে সেই প্রমাণ পেয়েছে। আদালত জামিন মঞ্জুর না করে পুলিশকে ওই প্রতিবেদন দিতে বলেছেন,” বেনারকে জানান রসরাজের আইনজীবী মো. নাসির মিয়া।
এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় হিন্দু মহাজোটের সভাপতি ড. প্রভাস চন্দ্র রায় প্রশ্ন তোলেন, যেখানে তথ্য–প্রমাণ বলছে যে, রসরাজ ওই ছবি পোস্ট করেননি, সেখানে তাকে জেলে থাকতে হবে কেন? বেনারকে তিনি বলেন, “আমরা নাসিরনগরের ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি ও হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও আহ্বান জানাচ্ছি। পাশাপাশি অবিলম্বে নিরীহ রসরাজের মুক্তি চাই।”
গতকাল বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্র্যাব) কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রসরাজের বাবা জগন্নাথ চন্দ্র দাস বলেন, ফেইসবুকে ইসলাম অবমাননার ঘটনা ‘সাজিয়ে’ কেউ পরিকল্পিতভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ও মন্দিরে হামলা চালিয়েছে।
“আমার ছেলে পড়াশোনা জানে না । কোনো দিন স্কুলে যায়নি। বড় ভাই আর বাবার সঙ্গে বালিঙা বিলে মাছ ধরত,” সংবাদ সম্মেলনে জানান নমিতা রানি দাস।
“আমরা দুই ভাই নাম লিখতে পারি না । খালি পলাশ দুই তিন ক্লাস পড়ছে,” জানান রসরাজের ভাই দয়াময়। তিনি জানান, তাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে কেবল ছোট ভাই পলাশ স্কুলে গিয়েছিল।
ঘটনার পর রসরাজের পরিবার ভারতে পালিয়ে গেছে মর্মে প্রচারের প্রতিবাদ জানান রসরাজের বাবা জগন্নাথ চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, “আমরা দেশেই আছি। কেউ ভারতে যাইনি।”
জামিন প্রসঙ্গে রসরাজ দাসের বিরুদ্ধে দায়ের করা ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “আদালতের নির্দেশে পুলিশ আসামির মুঠোফোনের ফরেনসিক প্রতিবেদন জমা দেবে। আদালতই জামিনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।”