প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর আহ্বান

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.12.09
একটি মেডিকেল সেন্টারে চূড়ান্ত মেডিকেল পরীক্ষার জন্য লাইনে অপেক্ষমান বিদেশ গমনেচ্ছুরা। একটি মেডিকেল সেন্টারে চূড়ান্ত মেডিকেল পরীক্ষার জন্য লাইনে অপেক্ষমান বিদেশ গমনেচ্ছুরা। সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৬।
স্টার মেইল

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মরত বাংলাদেশি গৃহকর্মীরা নানাভাবে নিগৃহিত হচ্ছেন অভিযোগ তুলে তাদের সুরক্ষায় উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

বৃহস্পতিবার সংস্থাটির এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানানো হয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অধিক সংখ্যক কর্মী পাঠোনোর লোভ ও যে কোনো মূল্যে বাজার ধরার চেষ্টায় অসম চু্ক্তির মাধ্যমে কর্মী পাঠানোই এর জন্য দায়ী। তবে শ্রমিক নিগৃহিত হওয়ার বিষয়টিকে আংশিকভাবে মেনে নিয়ে, এর জন্য শ্রমিকদের অদক্ষতাকেই দায়ী মনে করছে সরকার।

এদিকে অভিবাসী গৃহকর্মীদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দেশের রিক্রুটিং এজেন্সির ওপর নজরদারি বাড়ানো, বিদেশে কর্মরত অবস্থায় সুরক্ষা প্রদান এবং দুর্দশার সময় সহযোগিতা করারও সুপারিশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

বিদেশ যাওয়ার আগে চূড়ান্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে আসা ছাত্ররা।
বিদেশ যাওয়ার আগে চূড়ান্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে আসা ছাত্ররা।
স্টার মেইল।
কতটা পিছিয়ে বাংলাদেশ

এইচআরডব্লিউ জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গৃহকর্মী পাঠানো, তাদের অধিকার সংরক্ষণে ব্যর্থতা ও নিম্নমজুরি নির্ধারণের কারণে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ বিছিন্ন হয়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং নেপাল তাদের অভিবাসী গৃহকর্মীদের উপর বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। এতে করে তাদের সুরক্ষা ও বেতনের পরিমাণ বেড়েছে।

ঢাকায় শনিবার থেকে শুরু হতে যাওয়া দুই দিনব্যাপী গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সম্মেলনকে সামনে রেখে এ বিবৃতি দিয়েছে এইচআরডব্লিউ। এ সম্মেলনে অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষার ইস্যুটি নিয়ে জোরালো ভূমিকা রাখারও আহ্বান জানায় সংস্থাটি।

এ বিষয়ে এইচআরডব্লিউ’র মধ্যপ্রাচ্যে নারী অধিকার বিষয়ক গবেষক রত্না বেগম বলেন, “অভিবাসন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্মেলনের আয়োজন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ, অথচ বিদেশে তাদের কর্মীদের সুরক্ষায় তেমন কোনো জোরালো ভূমিকা নেই।”

রত্না বেগমের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের আইন ও রীতিনীতি গৃহকর্মী নির্যাতনে উৎসাহিত করে।
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “কাফালা সিস্টেমের যাঁতাকলে কোনো গৃহকর্তা নির্যাতন করলেও অন্য কোথাও কাজ নেয়ার তো সুযোগ তাদের নেই। তার ওপর কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিথ্যা অভিযোগ করে গৃহকর্মীকে পুলিশি হয়রানিও করা হয়।”

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ৫৯ জন কর্মীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ওমানে ‘অভিবাসী গৃহকর্মীদের ওপর বঞ্চনা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। যার মধ্যে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিও ছিলেন।

এসব বাংলাদেশিদের বেশিরভাগেরই অভিযোগ, নিয়োগদাতারা তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নিয়েছেন। অনেকেই পুরো বেতন পান না, কোনো ছুটি বা বিশ্রাম ছাড়া, জোর করে লম্বা সময় ধরে কাজ করানো হচ্ছে।

অনেকে খাবার ও থাকার জায়গা পান না বলে অভিযোগ করেন। এদের মধ্যে কারো কারো অভিযোগ গৃহকর্তার কাছে শারীরিকভাবে নিপীড়নের শিকার হওয়া, কয়েকজন আবার যৌন নির্যাতনের বর্ণনাও দিয়েছেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওই প্রতিবেদনে দেখানো হয়, বাংলাদেশি কর্মীদের ওপর অত্যাচারের বিবরণ সবচেয়ে ভয়াবহ; যার মধ্যে জোরপূর্বক কাজ করানো এবং মানব পাচার রয়েছে।

এতে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি নারী কর্মী পাঠানোর সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি নারী কর্মী জর্ডান ও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে একা কাজ করতে গেছেন।

অসম চুক্তি মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা

এদিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিছু বিষয়ের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশর বিশ্লেষকরা। অভিবাসী শ্রমিকদের নির্যাতিত হওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের মধ্যে হওয়া অসম চুক্তিকেই দায়ী করেছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে অভিবাসী অধিকার বিষয়ক সংগঠন ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন এর চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক বেনারকে বলেন, সৌদি আরব কিংবা জর্ডানের সঙ্গে মহিলা শ্রমিক পাঠানোর চুক্তিটি অসম। এ চুক্তি বাতিল করে অভিবাসীবান্ধব চুক্তি করতে হবে।”

তাঁর মতে, বাসা বাড়িতে থাকার পরিবর্তে রাহা সিস্টেমে কাজ করাতে হবে। এই পদ্ধতিতে গৃহকর্মীদেরকে কোম্পানীর হোস্টেলে রাখা হয়, প্রতিদিন সকালে তাকে গৃহকর্তার বাড়িতে দিয়ে আসা হয়, আর কাজ শেষে ফেরত আনা হয়।”

বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস কিংবা মিশনগুলোও প্রবাসীদের সেবা দিতে ব্যর্থ অভিযোগ করে তিনি বলেন, “সরকারের সবচেয়ে কম বাজেট প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। অথচ প্রবাসীদের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি টাকা আয় করে থাকে।”

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনর (বমসা) পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বেনারকে বলেন, “অভিবাসীদের অধিকার সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমস্যার কারণে।”

নির্যাতন কমাতে একটি নির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “নারী অভিবাসীদের জন্য এমন ম্যাকানিজম করতে হবে, যাতে নারীর গায়ে হাত তোলার সাহস হবে না কারো। এমন সুরক্ষা হবে যাতে বেতন না দিয়ে বাঁচতে পারবে না কেউ। মোট কথা একসেস টু জাস্টিস নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। সেটা দেশে এবং দেশের বাইরে সবখানেই।”

তবে বাংলাদেশে অভিবাসন খাতের অনেক ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন এই অধিকার কর্মী।

দক্ষ শ্রমিক তৈরি করছে সরকার

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন প্রবাসী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ। তিনি বেনারকে বলেন, “হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত নই। ফিলিপাইন এবং নেপালের মতো আমরাও আমাদের শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য জোর আওয়াজ তুলে থাকি “

তবে অদক্ষ শ্রমিক বেশি যাওয়ায় মজুরি কম পাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে আমরা বেশি যাই। সেজন্য আমাদের বেতন কম, অন্যদের তুলনায়।”

তাঁর মতে, শ্রমিকের দক্ষতা বাড়ানো হলে বেতন ও সুবিধা বাড়বে। আর এ কারণে এখন আমরা দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে মনোযোগী হয়েছি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।