বিদায়ী বছরে বাংলাদেশে ধর্ষণ বেড়েছে দ্বিগুণ, সীমান্ত হত্যা তিনগুণ: আসক

জেসমিন পাপড়ি
2020.01.03
ঢাকা
200103_ASK_Report_1000.jpg ফেনীর সুবর্ণচরে এক নারীকে গণধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে রাজধানীর শাহবাগে যৌন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী জোটেৱ মানববন্ধন। ১১ জানুয়ারি ২০১৯।
[নিউজরুম ফটো]

আগের বছরের তুলনায় সদ্য বিদায়ী বছরে বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ, সীমান্তে হত্যা প্রায় তিনগুণ। তবে গুমের ঘটনা নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে। এমনই তথ্য বেরিয়ে এসেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ২০১৯ সালের বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হেফাজতে মৃত্যু, গুম ও মতপ্রকাশের অধিকারের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে ২০১৯ সালের শেষ দিনে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের বার্ষিক প্রতিবেদনের এসব তথ্য তুলে ধরে আসক।

দেশের অন্যতম এই মানবাধিকার সংগঠনটি জানায়, এই সময়ে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি।

আসক'র নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বেনারকে বলেন, “গত বছরের তুলনায় ২০১৯ সালে ধর্ষণ বেড়েছে দ্বিগুণ। এ ছাড়া যৌন হয়রানি, নির্যাতন ও হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের মতো ঘটনা অব্যাহত ছিল সারা বছর। মতপ্রকাশের অধিকারের চিত্রও ছিল উদ্বেগজনক।”

তবে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আসক'র প্রতিবেদনের সাথে একমত নন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বেনারকে বলেন, “দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ বলা হচ্ছে। আমি তা মনে করি না।”

ধর্ষণ বেড়েছে দ্বিগুণ

আসক'র প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৪১৩ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করছেন ১০ জন। ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৭৩২ নারী এবং ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮১৮ জন।

এদিকে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, বিচারহীনতা ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতাকে দায়ী করেন মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী।

তিনি বেনারকে বলেন, “ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি। অপরাধীরা পুলিশকেও ভয় পায় না। কারণ, তারা জানে অপরাধ করলেও তারা বের হয়ে আসবে।”

“এছাড়া এসব সেন্সেটিভ মামলার তদন্ত ও বিচার যত দেরি হবে তত প্রমাণ হারিয়ে যাবে। এজন্য দেশে দ্রুত বিচার আদালতের সংখ্যা বাড়াতে হবে,” বলেন সালমা আলী।

ধর্ষণের ঘটনা কোনোভাবে মেনে নেয়া না গেলেও সরকারের পক্ষে ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

এ প্রসঙ্গে তিনি বেনারকে বলেন, “ধর্ষণ কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু সরকার কি ধর্ষণ বন্ধ করতে পারে? ধর্ষণের কারণ হলো সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতন।”

“আমেরিকা পৃথিবীর মধ্যে সবচে উন্নত দেশ। আমেরিকা কি ধর্ষণ বন্ধ করতে পেরেছে? আমাদের সরকারের কাজ হলো অপরাধ যারা করবে তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের ব্যবস্থা করা,” বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

তবে সরকার ধর্ষণকারীসহ সকল অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে বদ্ধ পরিকর বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, “যাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, নেয়া হচ্ছে।”

সীমান্ত হত্যা বেড়েছে তিনগুণ

আসক জানায়, ২০১৯ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ৩৭ জন ও শারীরিক নির্যাতনের কারণে ৬ জনসহ মোট ৪৩ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। আগের বছরের তুলনায় যা ছিল প্রায় তিনগুণ বেশি। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৪ জন।

“আমরা চাই সীমান্ত হত্যা শূন্যে নেমে আসুক,” মন্তব্য করে এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেন, “এ বিষয়টি আমরা ভারতের কাছে তুলে ধরেছি। গত ২৫ থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে অনুষ্ঠিত বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।”

তবে গত বছর বিএসএফের হাতে নিহত বাংলাদেশির সংখ্যা ৩৫ জন ছিল বলে বৃহস্পতিবার ঢাকায় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম।

“এই বছরে সীমান্তে নিহতের সংখ্যা বিগত ৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত বছর সীমান্তে ৩৫ জনের আনাকাঙ্খিত মৃত্যু হয়েছে,” বলেন বিজিবি প্রধান, জানায় বাসস।

কমেছে গুম, অব্যাহত বিচারবহির্ভূত হত্যা

আসক'র প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের তুলনায় ২০১৯ সালে গুমের অভিযোগের সংখ্যা কিছুটা কমলেও বছর জুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুসহ গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে।

সংগঠনটির হিসাবে ২০১৯ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার শিকার হন ৩৮৮ জন। যা ২০১৮ সালে ছিল ৪৬৬ ও ২০১৭ সালে ছিল ১৬২ জন।

এ ছাড়া বিদায়ী বছরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হয়েছেন ১৩ জন। এর মধ্যে ৫ জনের সন্ধান পাওয়া গেলেও এখনো নিখোঁজ ৮ জন। এই সংখ্যা ২০১৮ সালে ছিল ৩৪ ও ২০১৭ সালে ৬০ জন।

তবে আসক’র এই তথ্য প্রত্যাখ্যান করে দেশে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে না বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

তিনি বেনারকে বলেন, “দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে না। দেশের ক্রসফায়ারের প্রতিটি ঘটনা একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তদন্ত দল তদন্ত করে। সে তদন্তে যদি বেরিয়ে আসে যে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তাহলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।”

একই সাথে বাংলাদেশে গুমের ঘটনাও ঘটছে না বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

“আমরা মনে করি না দেশে জোরপূর্বক গুমের ঘটনা ঘটছে। আমরা গুমের অভিযুক্ত অনেক ঘটনা তদন্ত করে দেখেছি যে ওগুলো গুম ছিল না,” বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

এদিকে গত বছর বাংলাদেশে গুমের ঘটনা কমেছে- এ বিষয়ে আসক'র প্রতিবেদন সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এনজিওরা কখনো বলে যে কথিত গুমের ঘটনা বেড়েছে, আবার কখনো বলে কমেছে। এসব বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবে।”

৪৮৮ শিশু হত্যা

আসক'র তথ্য অনুযায়ী-২০১৯ সালে দেশে ৪৮৮ শিশুকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে কয়েকজনকে অপহরণের পর খুন করা হয়। বিগত বছর এ সংখ্যা ছিল ৪১৯। এ ছাড়া ২০১৯ সালে এক হাজার ৬৯৬টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়।

আসক’র সিনিয়র উপপরিচালক নিনা গোস্বামী জানান, ২০১৯ সালে ১৪২ জন সাংবাদিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, স্থানীয় দুর্বৃত্ত ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

এ ছাড়া দেশব্যাপী রাজনৈতিক সংঘর্ষে গত বছর ৩৯ জন নিহত ও দুই হাজার ৬৮৯ জন আহত হন।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।