ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক বাউলের মুক্তি দাবি

জেসমিন পাপড়ি
2020.01.13
ঢাকা
200113_BAUL_ARRESTED_1000.jpg ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তারের পর শরিয়ত বয়াতিকে (ডানে) টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানায় নেওয়া হয়। ১১ জানুয়ারি ২০২০।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশে একজন বাউল শিল্পীকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তাঁর মুক্তি দাবি করেছেন বিভিন্নজন।

পুলিশ জানায়, ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার ধামরাইয়ে পালাগানের একটি অনুষ্ঠানে ইসলামের নবী এবং ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করার অভিযোগ ওঠে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার বাউল শরিয়ত সরকারের (৩৫) বিরুদ্ধে। সেটি ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় বিক্ষোভ হয় এবং স্থানীয় এক ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।

তবে প্রতিবাদকারীরা বলছেন, এটা মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ। ইসলামপন্থীদের সাথে সরকারের আঁতাতের ফলে একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন তাঁরা।

বামপন্থী সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি বাকি বিল্লাহ বেনারকে বলেন, “আমাদের দেশে ইসলামের ঐতিহাসিক ধারার সাথে রাজনীতি ও সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তারই ফল এটা।”

“সরকার ইসলামপন্থীদের সাথে সমঝোতা করে চলায় পরিস্থিতি দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। এখন গ্রামেগঞ্জে বাউল, বয়াতিদের গোষ্ঠী টিকে থাকতে পারছে না,” বলেন তিনি।

টাঙ্গাইলের বাউল শিল্পী শরিয়ত বয়াতিকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়ার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে তাঁর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছেন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার।

সোমবার দেওয়া এক বিবৃতিতে তাঁরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বিভিন্ন স্থানে শরিয়ত বয়াতির মতো বাউল শিল্পীদের গ্রেপ্তার-নির্যাতনের ক্ষমাহীন অপরাধের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

জাসদ নেতারা জঙ্গিবাদী-মৌলবাদীদের সাথে আঁতাতকারী প্রশাসন ও পুলিশের এ ধরনের কর্মকর্তাদের অপসারণ করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।

আন্দোলনের হুমকি

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত ইসলামে গান জায়েজ কি না—এই মতবিরোধের জেরে আটক করা হয়েছে সুফি মতাদর্শের অনুসারী শরিয়ত বয়াতিকে।

সুফিপন্থিরা মনে করেন, গানের সাথে ইসলামের কোনো বিরোধ নেই।

সুফিবাদে বিশ্বাসী খিলাফতপ্রাপ্ত তরিকপন্থী পীর পাগল মাজেদ চান আল চিশতি বেনারকে বলেন, “দেখুন, সুফি ও ওহাবি মতাদর্শীদের ভিন্নতার শিকার হয়েছেন শরিয়ত বয়াতি। ওহাবিরা তাঁর কিছু বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করে ডিজিটাল আইনে এই মামলা করেছে।”

তিনি বলেন, “গান বাজনা নিয়ে শরিয়ত বয়াতি যে কথা বলেছেন তার পক্ষে আমার কাছেও যুক্তি আছে। এসব যে হারাম কোরআনের কোথাও সেটি সরাসরি বলা নেই।”

শরিয়ত বাউলের জামিন না হলে বাউল সমাজ আন্দোলনে নামবে বলেও জানান মাজেদ চান।

মামলার বাদী মাওলানা মো. ফরিদুল ইসলাম মির্জাপুর উপজেলার আগধল্যা দারুসসুন্নাহ ফোরকানিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক।

তিনি বেনারকে বলেন, “বাউলশিল্পী শরিয়ত সরকার তাঁর গানে মহানবী ও ইসলাম এবং হুজুরদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। সেটি ইউটিউবে দেওয়ার পরে বিষয়টি এলাকার মুসল্লিদের নজরে আসে। তাঁর বক্তব্যে মারাত্মকভাবে আহত ও মর্মাহত হয়ে মুসল্লিদের পক্ষে এই মামলাটি করেছি।”

“ইসলাম সম্পর্কে এমন কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের জন্য আমরা ওই বাউলের কঠোর শাস্তি চাই, যাতে আর কেউ ইসলামকে নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য দিতে না পারেন,” বলেন মাওলানা ফরিদ।

তিন দিনের রিমান্ডে বাউল

শনিবার ভোরবেলা ময়মনসিংহ থেকে শরিয়ত সরকারকে আটক করে পুলিশ। বর্তমানে তিনি তিন দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। মঙ্গলবার তাঁকে কারাগারে পাঠানো হবে বলে বেনারকে জানিয়েছেন মির্জাপুর থানার ওসি সায়েদুর রহমান।

“রিমান্ডে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে,” মন্তব্য করে ওসি সাইদুর বলেন, “শরিয়ত বয়াতির বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তিনি গান গাওয়া জায়েজ কিনা সেই বিতর্কে নবী করিম হযরত মুহম্মদ (সাঃ) ও টুপিওয়ালা হুজুরদের সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন। এ ছাড়া কোরআন শরিফে গান বাজনা নিষেধকে চ্যালেঞ্জ করে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেছেন। এ সংক্রান্ত তাঁর বক্তব্য ইউটিউবে রয়েছে।”

তিনি বলেন, “এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে টাঙ্গাইলের ওলামারা বিরাট সমাবেশ করেন। তাঁকে দুদিনের মধ্যে আটক না করা হলে আরও বড় কর্মসূচির হুঁশিয়ারিও দেন তাঁরা।”

“পরে মাওলানা মো. ফরিদুল ইসলাম বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মির্জাপুর থানায় শরিয়ত বয়াতির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এই মামলার প্রেক্ষিতেই তাঁকে শনিবার ভোরে ময়মনসিংহ থেকে আটক করা হয়,” বলেন এই ওসি।

হুমকিতে বাউলরা

ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তুলে দেশের বিভিন্ন স্থানে এর আগেও বাউল ও লালনভক্তদের ওপর জঙ্গি ও উগ্রপন্থিদের হামলা ও হুমকির ঘটনা ঘটেছে।

২০১৬ সালের মে মাসে কুষ্টিয়ায় দুর্বৃত্তদের চাপাতির আঘাতে নিহত হন বাউলভক্ত চিকিৎসক মীর সানাউর রহমান। এর পরের বছর ডিসেম্বরে চুয়াডাঙ্গায় বাউল উৎসবের এক আয়োজককে হত‌্যা করে জঙ্গিরা।

চুয়াডাঙ্গায় জীবননগর উপজেলার এক লালন আখড়ায় ২০১৬ সালে দুইবার মৌলবাদীদের আক্রমণের ঘটনা ঘটে। একই বছর নেত্রকোণার কেন্দুয়ায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে লালন শাহ স্মরণে আয়োজিত একটি গানের আসর বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২০১৮ সালের অক্টোবরে মাদরাসা ছাত্রদের হামলার শিকার হন বাউল শিল্পী শামসুল হক চিশতি। ২০১৯ সালের অক্টোবর বাউল শিল্পী সুভাস রোজারিওকে নিখোঁজ হওয়ার ২৫দিন পর কুষ্টিয়া থেকে উদ্ধার করে নাটোর জেলা পুলিশ।

“লোকসংগীত, বাউলগান আমাদের শেকড়। এই সংগীত জীবন ও আত্মার কথা বলে,” গত ১ জানুয়ারি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে এক অনুষ্ঠানে বলেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

তবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে বলে বিবিসি বাংলার কাছে মন্তব্য করেছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।

তিনি বলেন, “লোকজ সংস্কৃতিসহ সব কিছুর পৃষ্ঠপোষকতা এ সরকার করছে। এখন যদি কেউ ধর্মীয় অনুভূতিতে কোনো আঘাত দিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আমি হলেও আইনের আওতায় আসব। কারণ আইন সবার জন্য সমান।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।