ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রকাশককে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় উদ্বেগ
2020.02.13
ঢাকা
একটি পুরোনো মামলায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রকাশনা সংস্থা গার্ডিয়ান পাবলিকেশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানোর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে জামিন আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন নূর মোহাম্মদের আইনজীবী।
“দেখুন, মামলাটি ১৫ মাসের পুরোনো। এজাহারে বলা হয়েছে, ডমেইন কিনে তিনি কিছু ওয়েবপেইজ হোস্ট করেছেন, যেখানে সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন বা স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। আসলে ডোমেইনগুলো নূর কেনেননি এবং ওয়েবপেইজগুলো তাঁর নয়,” বেনারকে বলেন নূর মোহাম্মদের আইনজীবী মোজাহিদুল ইসলাম।
ওই আইনজীবী আরও বলেন, “ভিত্তিহীন অভিযোগে এটা একটা হয়রানিমূলক মামলা।” নূর মোহাম্মদের পক্ষে জামিন আবেদনের প্রস্তুতি চলছে বলেও জানান তিনি।
দেশে-বিদেশে সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টের অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গত ১১ ফেব্রুয়ারি নূর মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে র্যাব-২ এর সহকারী পরিচালক মিডিয়া মোহাম্মদ জাহিদ আহসান বেনারকে বলেন, নূর মোহাম্মদ এজাহারভুক্ত আসামি। তিনি জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তাঁরা সরকারবিরোধী প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছিলেন।”
“এ কাজে নামীদামি দেশি-বিদেশি পত্রিকার ওয়েবসাইটের আদলে ওয়েবসাইট তৈরি করে মূল পত্রিকার খবরের চুম্বক অংশ রেখে ভুয়া খবর প্রকাশ করছিলেন,” যোগ করেন তিনি।
“ধৃত আসামি নূর মোহাম্মদ গার্ডিয়ান পাবলিকেশনস ম্যানেজিং ডিরেক্টর। প্রথম আলোর অবিকল ওয়েব ডোমেইন হোস্টিং সংক্রান্তে জিজ্ঞাসাবাদে আসামি জানান, তাঁরা সরকার বিরোধী প্রপাগান্ডা ছড়ানোর কাজে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার কপি হুবহু ওয়েব হোস্টিং ডোমেইন করে থাকেন। নকল ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনলাইন পত্রিকা প্রকাশিত হলে সমর্থকরা বেশি লাইক শেয়ার দেবে এবং তাতে করে ফেসবুক থেকে বেশি টাকা আয় করা সম্ভব,” বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় র্যাব মিডিয়া উইং।
গ্রেপ্তারের স্থান নিয়ে ভিন্ন তথ্য
র্যাব জানায়, ২০১৮ সালের ২৪ নভেম্বর এ অভিযোগে কমলাপুর রেলওয়ে থানায় একটি মামলা হয়েছিল। সে মামলার অন্যতম আসামি এনামুল হক মণিকে প্রথমে র্যাব গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নূর মোহাম্মদকে মোহাম্মদপুরের বছিলা ক্যাম্প থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তবে নূরের আইনজীবী জানান, “হাটখোলা নামক স্থান থেকে থেকে নূর মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করা হলেও, মোহাম্মদপুরের বছিলা দেখানো হয়েছে।”
এদিকে নূর মোহাম্মদকে একদিন আগেই হাটখোলা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নিয়ে যায় বলে বেনারকে জানান তাঁর এক স্বজন। পুলিশি হয়রানির শিকার হতে পারেন এই আশঙ্কায় নাম প্রকাশ করতে চাননি তিনি।
তিনি বেনারকে বলেন, “সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সাদা পোশাকে একদল লোক নূর মোহাম্মদকে নিয়ে যান। তিনি হাটখোলায় তাঁর কার্যালয়ে বসা ছিলেন তখন।”
“পরে জানতে পারি তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা আছে,” ওই স্বজন বলেন।
তিনি আরও বলেন, মঙ্গলবার আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। তিনি এখন কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।
তবে র্যাব এক জায়গা থেকে গ্রেপ্তার করে অন্য জায়গায় দেখানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
নূর মোহাম্মদের প্রকাশনা সংস্থা গার্ডিয়ান পাবলিকেশনস মূলত ধর্মীয় বই প্রকাশ করে থাকে। এ বছরের একুশে বইমেলায় তাঁদের কোনো স্টল নেই। তবে অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থার প্যাভিলিয়নে তাঁদের বই রয়েছে।
যত অভিযোগ
র্যাব-২ এর কর্মকর্তা একরামুল হক চৌধুরী ২০১৮ সালের নভেম্বরে রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন। ওই এজাহারে ১৪ জনের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। নূর মোহাম্মদ তাঁদের একজন।
এজাহারে একরামুল মোটা দাগে অভিযোগ তোলেন। যার মধ্যে রয়েছে- বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ভুয়া ও সারবত্তাহীন মিথ্যা গুজব আসামিরা প্রচার করছে, এর উদ্দেশ্য দেশে–বিদেশে সরকার ও তার সমমনা রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তাকে খাটো করা। হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো ঘটনাগুলোকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করা ও সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা করা।
আবেদনে র্যাব বিভিন্ন সংবাদের লিংক যুক্ত করে।
আলোচনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
নূর মোহাম্মদ গ্রেপ্তারের পর আবারও আলোচনায় এসেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনের কয়েকটি ধারা কণ্ঠরোধের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে এ অভিযোগ আইনটি প্রণয়নের শুরু থেকেই রয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই আইনে ৪২জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বার্ষিক মানবাধিকার পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অধিকার বলেছে, ২০১৯ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি বা দলের নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সমালোচনা প্রকাশ হওয়ার কারণে নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করে নাগরিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তার করা হয়।
জানতে চাইলে আর্টিকেল নাইন্টিনের বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ফারুক ফয়সাল বেনারকে বলেন, “নূর মোহাম্মদ একটি প্রকাশনা সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তাঁকে এভাবে আটক করায় আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করছি। একই সঙ্গে আমরা ‘ফেক নিউজ’ এবং ‘হেট স্পিচের বিরুদ্ধেও।”
তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আমরা সব সময় উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছি। আন্তর্জাতিক মানের ক্ষেত্রে এই আইনের কী কী গাফিলতি আছে, সেটা আর্টিকেল নাইনটির পক্ষ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণ সরকারের কাছে তুলে ধরা হবে।”
ফারুক ফয়সাল বলেন, “কোনো প্রকার জানান না নিয়ে মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়া, দীর্ঘদিন তার খবর না পাওয়া এবং পরে আদালতের মাধ্যমে জেলখানায় তাকে পাঠানোর যে রেওয়াজ বাংলাদেশে শুরু হয়েছে, তা সুবিচারের মধ্যে পড়ে না। বিচারকে তার নিজস্ব ধারায় চলতে দিতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেন অপব্যবহার না হয়, তার জন্য সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।”
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।