সাংবাদিক কাজলের খোঁজ মিললেও গন্তব্য কারাগার

প্রাপ্তি রহমান
2020.05.04
ঢাকা
200504_BD_journalist_missing_1000.JPG নিখোঁজ হওয়ার প্রায় দুই মাস পর বেনাপোল সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে যশোরের আদালতে হাজির করে পুলিশ। ৩ মে ২০২০।
[বেনারনিউজ]

রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার প্রায় দুই মাস পর ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের (৫১) খোঁজ পাওয়া গেলেও তাঁর গন্তব্য এখন কারাগার। কবে মুক্তি মিলবে, তা বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কেউই।

কাজল অত দিন কোথায় ছিলেন—জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। এটা হয়তো তাঁর কাছ থেকে পরে জানা যাবে।

“আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আমাকে জানানো হয়েছে যে, বেনাপোল সীমান্ত এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভারত থেকে অবৈধ অনুপ্রেবেশের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে,” জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

রোববার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে উদ্ধারের পর প্রথমে পাসপোর্ট আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হয় কাজলকে। ওই মামলায় জামিনের পর পুলিশ ৫৪ ধারায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখায়। আদালতের নির্দেশে রোববার সন্ধ্যায় তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

“শিগগির শফিকুল মুক্তি পাবেন, এমন আশা দেখতে পাচ্ছি না। আমরা জামিন আবেদনের সুযোগ খুঁজছি,” বেনারকে বলেন যশোরে কাজলের আইনজীবী দেবাশীষ দাশ।

দেবাশীষ আরও বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে আদালত খুব অল্প সময়ের জন্য বসছে। রোববার দুপুরের পর পাসপোর্ট আইনে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পুলিশ কাজলকে আদালতে উপস্থাপন করেছিল। আদালত আদেশ দেওয়ার জন্য কিছুটা সময় নেয়, এরপর জামিন দেয়।

এরপর পুলিশ আদালতের কাছে নতুন আবেদন করে বলে, কাজলের নামে ঢাকার বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে। তাঁকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরপর আদালতের নির্দেশে শফিকুলকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

“আদালত আগামি ১৯ মে’র মধ্যে শফিকুলের বিরুদ্ধে চলমান মামলার অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন, তারপর তিনি এ ব্যাপারে আদেশ দেবেন বলে জানিয়েছেন,” দেবাশীষ দাশ বলেন।

গত ১০ মার্চ ঢাকার হাতিরপুল এলাকা থেকে নিখোঁজ হন কাজল। পরিবার অপহরণের মামলা করতে চাইলেও পুলিশ প্রথমে অস্বীকৃতি জানায়। এর পরের দিন আদালতের নির্দেশে পরিবার চকবাজার থানায় অপহরণ মামলা দায়ের করে।

ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে পরিবারের পক্ষ থেকে দেখা যায়, নিখোঁজ হওয়ার দিন সাত-আটজনের একটি দল তাঁর মোটরসাইকেলের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে।

যুব মহিলা লীগের সাবেক নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর কাজল যুব মহিলা লীগের নেত্রীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের সখ্য নিয়ে একাধিক পোস্ট ও ছবি প্রকাশ করেছিলেন।

র‍্যাব গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পাপিয়া ও তাঁর স্বামী মফিজুর রহমানকে আটক করে। সাবেক ওই নেত্রীর বিরুদ্ধে অসামাজিক কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি-অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়ার নানা কাহিনী গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। এর মধ্যে মানবজমিনের একটি প্রতিবেদন আলোচনায় আসে।

এ ঘটনায় মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে গত ৯ মার্চ রাতে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেন মাগুরা-১ আসনে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য মো. সাইফুজ্জামান শেখর।

মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, ২ মার্চ দৈনিক মানবজমিন পত্রিকা ‘পাপিয়ার মুখে আমলা, এমপি, ব্যবসায়ীসহ ৩০ জনের নাম’ শীর্ষক সংবাদ পরিবেশন করে।

এ প্রতিবেদনে ইঙ্গিতমূলকভাবে কয়েকজন সংসদ সদস্যের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ২৫ থেকে ৩০ জনের নামসহ একাধিক তালিকা ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তাসহ সাংসদ সাইফুজ্জামান শিখরের নাম রয়েছে।

ওই মামলায় উল্লেখ করা আসামিদের একজন শফিকুল ইসলাম কাজল, যার ফেসবুক আইডি থেকে ওইসব খবর ও তালিকা শেয়ার দেওয়া হয়।

এছাড়া কাজলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১০ মার্চ ঢাকার হাজারিবাগ থানা ও ১১ মার্চ তেজগাঁও থানায় আরো দুটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই দুটি মামলা দায়ের করেন যুব মহিলা লীগের নেত্রী ইয়াসমীন আরা বেলী ও যুব মহিলা লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীমা রহমান।

কোথায় ছিলেন কাজল

কাজলের ছেলে মনোরম পলক বেনারকে বলেন, এখন পর্যন্ত তাঁরা জানেন না, ঢাকা থেকে অপহরণের পর তিনি কীভাবে ভারতে গেলেন।

পলক বেনারকে বলেন, “বাবাকে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াই এখন আমার প্রধান কাজ, তিনি কীভাবে ভারতে গেলেন, সে সম্পর্কে আমি কথা বলতে পারিনি। সন্ধান পাওয়া গেলেও বাবা এখনও কারাগারে।”

চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুদ হাওলাদার এর আগে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ১০ মার্চ নিখোঁজ হওয়ার পরপরই কাজলের মুঠোফোন বন্ধ হয়ে যায়। অল্প সময়ের জন্য তাঁর মুঠোফোনটি চালু হয় গত ৯ এপ্রিল। তখন তাঁর অবস্থান দেখা যাচ্ছিল বেনাপোল।

কাজল উদ্ধার হওয়ার খবর তাঁর ছেলে পলক শনিবার দিবাগত রাত পৌনে তিনটার সময় পান।

পলক বলেন, “বেনাপোল পুলিশ স্টেশন থেকে ওবায়েদুর নামে এক পুলিশ সদস্য ফোন করে জানান বাবাকে পাওয়া গেছে। বাবাকে নিতে দ্রুত ঢাকা থেকে রওনা দেওয়ার কথাও বলেন তিনি।’

“অনেক রাতে বিজিবির একটা টহল দল উনাকে (কাজলকে) রেখে যায়। তারা বলেছে, ইন্ডিয়া থেকে উনি কাগজপত্র ছাড়াই পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে ঢুকেছেন,” বেনারকে বলেন বেনাপোল পুলিশ স্টেশনের সদস্য ওবায়েদুর রহমান।

তিনি জানান, পাসপোর্ট আইনে কাজলের বিরুদ্ধে মামলা করেন বিজিবি রঘুনাথপুর ক্যাম্পের হাবিলদার মো. আশেক আলী।

মামলার এজাহারে আশেক আলী বলেন, তাঁরা রঘুনাথপুরের গ্রাম এলাকায় টহল দিচ্ছিলেন। সে সময় মূল সীমান্ত পিলার থেকে ১০০ গজের মধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে এক ব্যক্তিকে ভারত থেকে হেঁটে আসতে দেখেন। টহল দল তাঁকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তিনি নিজেকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে পরিচয় দেন। কিন্তু তাঁর তাছে কোনো পাসপোর্ট ছিল না। তিনি দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসছিলেন বলে জানান।

এখন কাজলের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে?—জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র মাসুদুর রহমান বেনারকে বলেন, পুলিশ পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেবে।

তিনি বলেন, “শফিকুলের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তারা এখন শফিকুলের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর কার্যক্রম শুরু করবেন।”

‘কাজল অপরাধী নন, ভুক্তভোগী’

কাজল নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই তাঁর সন্ধান চেয়ে কর্মসূচি পালন করে আসছিল পরিবার ও বিভিন্ন সংগঠন।

রোববার ছিল বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। এই দিনে সাংবাদিক কাজলকে পিছমোড়া করে হাতকড়া লাগিয়ে যশোরের আদালতে হাজির করা হয়।

এর আগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কাজলের বিরুদ্ধে নিখোঁজ হওয়ার আগে-পরে দুটি মামলা দায়েরের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়। গত ১ এপ্রিল ওই বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি কাজলের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য জরুরি তদন্ত শুরু করতে ও সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানায়।

রোববার এক বিবৃতিতে গণমাধ্যম র্কীদের অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) কাজলের সব মামলা প্রত্যাহার করে তাঁর মুক্তির দাবি জানায়।

“কাজল অপরাধী নন, ভুক্তভোগী,” মন্তব্য করে বিবৃতিতে সিপিজের এশিয়া কর্মসূচির সমন্বয়ক স্টিভেন বাটলার বলেন, “কাজলকে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ ক্ষমতার অপব্যবহার।”

এদিকে করোনাভাইরাস মহামারির সময় ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করার দায়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে অন্তত ২০ জন সাংবাদিক সরকারি দলের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতন, হয়রানির শিকার অথবা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে রোববার এক বিবৃতিতে জানায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

একই সাথে জাতিসংঘের একটি ফাঁস হওয়া নথির ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন প্রকাশের দায়ে মার্চের শেষ দিকে বাংলাদেশে বেনারনিউজের ওয়েবসাইট ব্লক করে দেবার কথাও উল্লেখ করে অ্যামেনেস্টি।

জাতিসংঘের ওই নথিতে আশঙ্কা করা হয়েছিল, সঠিক পন্থা গ্রহণ না করলে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারিতে প্রায় বিশ লাখ পর্যন্ত মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

এর পর থেকেই বাংলাদেশের পাঠকরা আর বেনারনিউজের সাইটে ঢুকতে পারছেন না।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।