ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সরকারদলীয় নেতার মামলায় সাংবাদিক গ্রেপ্তার

শরীফ খিয়াম
2020.05.05
ঢাকা
200505_imprisonment_journalists-1000.jpg কারাবন্দী সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের মুক্তির দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তাঁর সহকর্মী-সুহৃদদের মানববন্ধন। ৫ এপ্রিল ২০২০।
[বেনারনিউজ]

চলতি মাসের প্রথম পাঁচ দিনেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশ্লিষ্ট মামলায় দেশে গ্রেপ্তার হয়েছেন পাঁচজন সাংবাদিক। সর্বশেষ সোমবার দিবাগত রাতে সুনামগঞ্জে গ্রেপ্তার হয়েছেন মাহতাব উদ্দিন তালুকদার।

মাহতাব (৪০) বেসরকারি এসএ টেলিভিশনের সুনামগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি এবং স্থানীয় দৈনিক হাওরাঞ্চলের কথার প্রকাশক ও সম্পাদক।

মাহতাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সোমবার রাতে তিনি নিজের ফেসবুকে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে একটি মিথ্যা তথ্য প্রচার করেন।

ওই ঘটনায় ধর্মপাশা উপজেলার সেলবরষ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বেনুয়ার হোসেন খান পাঠান সোমবার রাত ১১টার দিকে মাহতাবের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।

ওই মামলার প্রেক্ষিতে মাহতাবকে তাঁর সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার বলাকাপাড়ার বাসা থেকে সোমবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে বেনারকে জানান ধর্মপাশা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন।

তিনি বলেন, “আদালত তাঁকে (মাহতাব) জেল হাজতে পাঠিয়েছেন। মামলার অভিযোগ তদন্ত করে খুব দ্রুতই আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।”

তবে স্থানীয় সাংবাদিকেরা বলছেন, মাহতাবের ফেসবুক আইডি কে বা কারা হ্যাক করেছিল।

“অভিযুক্ত সাংবাদিক মাহতাব উদ্দিন তালুকদার ফেসবুকে পোস্ট দিয়েও দাবি করেছিলেন যে, তাঁর আইডি হ্যাক করা হয়েছে,” বেনারকে বলেন সুনামগঞ্জের স্থানীয় সাংবাদিক আশিকুর রহমান পীর।

মাহতাবের ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি প্রায় ছয় ঘণ্টা তাঁর নিজের নিয়ন্ত্রণে না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “বিষয়টির তদন্ত হতে পারত। সামাজিকভাবেও নিষ্পত্তির সুযোগ ছিল। আমরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।”

“ওই সাংবাদিককে যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন,” বেনারকে বলেন সুনামগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক একেএম মহিম।

গত ৯ মার্চ আওয়ামী লীগের সাংসদ সাইফুজ্জামান শেখর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে মামলার করেন। ওই মামলার একজন আসামি ছিলেন শফিকুল ইসলাম কাজল। মামলা দায়েরের পরদিন থেকেই তিনি নিখোঁজ ছিলেন।

গত রোববার তাঁকে বেনাপোল সীমান্ত থেকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।

এর আগে শুক্রবার নরসিংদীতে পুলিশের করা একই আইনের একটি মামলায় স্থানীয় তিন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁরা হলেন স্থানীয় দৈনিক গ্রামীণ দর্পণ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক রমজান আলী প্রামাণিক (৪৫), একই পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার শান্ত বণিক (৩৫) এবং অনলাইন পোর্টাল নরসিংদী প্রতিদিনের প্রকাশক ও সম্পাদক খন্দকার শাহিন (৩২)।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক ও সোস্যাল মিডিয়া এ্যাক্টিভিস্টদের হেনস্থার নেপথ্যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতার আশেপাশের লোকজনেরাই আছেন।”

“এর মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, ক্ষমতাধর বা ক্ষমতার আশেপাশে থাকা মানুষদের অসহিষ্ণুতা বেড়ে গেছে। পরিস্থিতি এমন থাকলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না,” যোগ করেন তিনি।

সাংবাদিক কাজলের মুক্তি দাবি

ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে যশোর কারাগারে পাঠানো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের অবিলম্বে মুক্তির দাবি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন। প্রায় দুই মাস ধরে নিখোঁজ থাকা কাজলকে উদ্ধারের পর তাঁর বিরুদ্ধে আইনী প্রক্রিয়ার অপব্যবহার করা হয়েছে দাবি করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ জানিয়েছে সংস্থাটি।

গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে মঙ্গলবার আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, “করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার যখন কারাবন্দীদের মুক্তি দিচ্ছে, তখন কাজলকে যে প্রক্রিয়ায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে তার কোনো যৌক্তিকতা নাই। খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো ভয়ঙ্কর কোনো মামলার আসামি কাজল নন।”

“তারঁ বিরুদ্ধে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিন্ন যে তিনটি মামলা হয়েছে, তা কেবল ফেসবুকে মত প্রকাশের জন্য। এসব মামলার অন্তত একটিতে অন্য আসামিরা জামিনে মুক্ত আছেন। তাহলে কাজলকে আটকে রাখার জন্য কেন এত তোড়জোড়?” প্রশ্ন রেখেছেন তিনি।

কাজলের মুক্তির দাবিতে মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছেন কাজলের কয়েকজন সহকর্মী ও সুহৃদ। এই কর্মসূচির আহবায়ক ও কাজলের সহকর্মী আলোকচিত্রী জীবন আহমেদ বেনারকে বলেন, “আমরা সরকারের কাছে তাঁর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়েছি।”

এর আগে সোমবার দুপুরেই কাজলকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য আদালতে আবেদন করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।

আলোচনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়েরের ঘটনায় আলোচনায় এসেছে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এ ব্যাপারে আর্টিকেল নাইনটিন বলেছে, বিতর্কিত আইনটিতে একের পর এক মামলা করার মাধ্যমে সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমকে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। সংগঠনটি আইনটি বাতিলের দাবি জানায়।

নূর খান লিটন বলেন, “করোনার এই ক্রান্তিকালে দেশে বিভিন্ন অপরাধসহ যেকোনো বিষয়ে মামলার সংখ্যা যখন নিম্নগামী, তখন সাংবাদিক ও সোস্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।”

আর্টিকেল নাইনটিন জানায়, ২০১৮ সালে সাংবাদিকসহ মত প্রকাশকর্মীদের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৭১টি মামলা হয়। ২০১৯ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় ৬৩টি।

সংগঠনটির হিসেবে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এ সংক্রান্ত ৪৫টি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশই করা হয়েছে গণমাধ্যমের সাংবাদিক ও সম্পাদকদের বিরুদ্ধে।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান বেনারকে বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করার অর্থ তাঁদের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করা। মামলা দিয়ে ভীতি তৈরির বেশ কিছু নজির আমরা এরই মধ্যে দেখেছি।”

“আমরা সব সময় বলে আসছি, কেউ যদি কোনো সংবাদের কারণে সংক্ষুব্ধ হয়, তবে তার প্রথমে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ পাঠানো উচিত। তাতেও প্রতিকার না পেলে প্রেস কাউন্সিলে যাওয়া উচিত, যেটি একটি আধাবিচারিক সংস্থা,” বলেন তিনি।

করোনা মহামারির কালে এর আগে দেশের প্রথম সারির অনলাইন পোর্টাল বিডি নিউজের প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী এবং জাগো নিউজের সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) মহিউদ্দিন সরকারসহ মোট আটজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে গত ২২ এপ্রিল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি।

এদিকে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও হয়রানির জন্য ক্রমাগতভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার কথা উল্লেখ করে সোমবার এক সম্পাদকীয়তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র মতে, মঙ্গলবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্ত হয়েছেন দশ হাজার ৯২৯ জন এবং মারা গেছেন ১৮৩ জন।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, মঙ্গলবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৬ লাখ ৪০ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন দুই লাখ ৫৫ হাজারের বেশি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।