সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের তিন দিনের মাথায় অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘পরিবর্তন ডটকম’ বন্ধ করে দেবার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন—বিটিআরসি।
‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নামের একটি সামাজিক সংগঠনের নামে ‘সন্দেহভাজন জঙ্গি সদস্য শনাক্তকরণ’ বিষয়ে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ নিয়ে প্রতিবেদন করার জের ধরে গত রোববার সংবাদমাধ্যমটি বন্ধ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয় নিয়ে গবেষণা করা সাবেক সাংবাদিক তাসনিম খলিল।
তবে ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ বলেছে, বিজ্ঞাপনটি প্রকাশের সাথে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই।
পরিবর্তন ডটকম বন্ধ করার সপ্তাহ দুই আগে কবি হেনরি স্বপন এবং আরও দুই মানবাধিকার কর্মীকে তথ্য প্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল আইনে গ্রেপ্তার করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির রোববারের সভায় তথ্য প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মানবাধিকার কর্মী এবং কবিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সাংসদ পীর ফজলুর রহমান।
বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন অবিলম্বে পরিবর্তন ডটকমসহ গত ১০ বছরে যে কয়টি অনলাইন সংবাদমাধ্যম সরকার বন্ধ করেছে সেগুলো খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
‘পরিবর্তন ডটকম’ কেন বন্ধ করা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে বিটিআরসি চেয়ারম্যান জহুরুল হক বুধবার বেনারকে বলেন, “যেটা জানি তা হলো, সাইটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে কেন বন্ধ করা হয়েছে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কারণ বলতে পারব না।”
চেয়ারম্যান বলেন, “সাধারণত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার খাতিরে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা সাইট বন্ধ করে থাকি।”
পরিবর্তন ডটকমের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আবু সুফিয়ান বুধবার বেনারকে বলেন, “রোববার বেলা ১১টার দিকে আমাদের সাইট ব্লক করা হয়। কারণ জানতে আমরা বিটিআরসি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। কিন্তু কেন বন্ধ করা হলো তা নিয়ে কেউ কিছু বলতে পারেনি।”
সরকার-বিরোধী সাংবাদিক সংগঠন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন—বিএফইউজের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী ও মহাসচিব এম. আব্দুল্লাহ এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন— ডিইউজের সভাপতি কাদের গণি চৌধুরী এবং মহাসচিব শহীদুল ইসলাম বুধবার এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩৫টি এবং ২০১৪ সালে থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ৫৪টি সংবাদমাধ্যম ব্লক করেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, “সরকার অব্যাহতভাবে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের যে অপকৌশল গ্রহণ করেছে তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।”
অবিলম্বে পরিবর্তন ডটকমসসহ এর আগে বন্ধ করা সকল গণমাধ্যম খুলে দিয়ে সংবাদমাধ্যমের ওপর দৃশ্য-অদৃশ্য সব ধরনের খড়্গ তুলে নেওয়ার দাবি জানান নেতৃবৃন্দ।
সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দেয়াকে তাঁরা ‘স্বৈরাচারী ও হঠকারী’ সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেন।
সর্বশেষ মার্চ মাসে একটি সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর কাতার ভিত্তিক আল-জাজিরা ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয় সরকার।

কেন বন্ধ করা হলো ?
গত ১২ মে দেশের প্রধান দুই দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সব প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে ‘সন্দেহভাজন জঙ্গি শনাক্তকরণ নিয়ামকসমূহ’ শিরোনামে একটি বিতর্কিত বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়।
বিজ্ঞাপনটি সম্প্রীতি বাংলাদেশ নামক একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সৌজন্যে প্রকাশিত হয়। এই সংগঠনের নামে প্রায় প্রতি সপ্তাহে আলোচনা সভা, সেমিনার বা গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করা হয়। সংগঠনটির প্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পীযূষ বন্দোপ্যাধ্যায়।
ওই বিজ্ঞাপনে অন্যান্য বিষয় ছাড়াও বলা হয়, ‘হঠাৎ করে দাঁড়ি রাখা এবং টাখনুর ওপর কাপড় পরিধান করা’ জঙ্গিবাদের লক্ষণ। বিষয়টি জঙ্গিবাদ হলেও বিজ্ঞাপনটিতে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে।
বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ে সম্প্রীতি বাংলাদেশ। গত ১৬ মে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বিজ্ঞাপনটির সাথে তাঁর সংগঠন সম্প্রীতি বাংলাদেশের কোনও সম্পর্ক নেই বলে জানান।
বুধবারও তিনি বেনারকে বলেন, “এই বিজ্ঞাপনের সাথে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই।”
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেন, “মিথ্যা তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে আমাদের সংগঠন সম্পর্কে জাতিকে বিভ্রান্ত করার একটি নীল নকশা ছাড়া আর কিছু না।”
তবে গবেষক তাসনিম খলিল তাঁর ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, পরিবর্তন ডটকম একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, “সম্প্রীতি বাংলাদেশের বিতর্কিত বিজ্ঞাপনটি যদি পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর সংগঠন না দিয়ে থাকেন, তাহলে এতগুলো পত্রিকায় টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপনটি কে দিয়েছে?”
তাসনিম খলিল বলেন, “শুনেছি এই প্রশ্নটি করার কারণেই বাংলাদেশে পরিবর্তন ডটকমে ওয়েবসাইটের একসেস বন্ধ করেছে বিটিআরসি।”
মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন
বরিশালে কবি হেনরি স্বপন, মানবাধিকার কর্মী আব্দুল কাইয়ুম ও ইমতিয়াজ মাহমুদকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়।
বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বাতিলকৃত ৫৭ ধারায় তিন মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন জাতীয় পার্টি সাংসদ পীর ফজলুর রহমান।
সভা শেষে তিনি বেনারকে বলেন, “আজকের সভায় আমি বলেছি, হেনরি স্বপনসহ তিন মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তারে সাধারণ মানুষ ব্যথিত হয়েছে। ৫৭ ধারা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার বাংলাদেশে একটি সংবেদনশীল বিষয়। এটি মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য ভালো কথা নয়। ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে পুলিশকে সচেতন থাকতে হবে।
কমিটির সভাপতি শামসুল হক টুকু বেনারকে বলেন, পীর ফজলুর এ ব্যাপারে কথা বলেছেন। তবে জবাবে পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি।
সভা থেকে বেরিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেননি।