ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গ্রেপ্তার

জেসমিন পাপড়ি
2020.06.18
ঢাকা
200618_UNIVERSITY_TEACHER_ARRESTED_1000.JPG ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সাংবাদিকদের সমাবেশ। ১১ অক্টোবর ২০১৮।
[রয়টার্স]

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিনদিনের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। দুজনের বিরুদ্ধেই সদ্য প্রয়াত সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমকে নিয়ে সামাজিক ফেসবুকে কটূক্তির অভিযোগ আনা হয়েছে।

সর্বশেষ বুধবার রাত দুইটার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাহিদুর রহমানকে নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম মাসুদ পারভেজ বেনারকে বলেন, “বৃহস্পতিবার সকালে তাঁকে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছেন।”

এর আগে ১৭ জুন রাত সাড়ে নয়টায় জাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে এই থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি ধারায় মামলা দায়ের করেন তাপস কুমার সাহা নামে একজন আইনজীবী। তিনি বোয়ালিয়া থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক।

“এই মামলার প্রেক্ষিতেই জাহিদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে,” বলেন ওসি মাসুদ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. এম এ বারী বেনারকে বলেন, “শিক্ষক কাজী জাহিদুর রহমানের গ্রেপ্তারের খবর শুনেছি। ফেসবুকে তাঁর পোস্টও আমাদের নজরে এসেছে। শিক্ষক জাহিদ একজন প্রথিতযশা নেতা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁর বাবা সম্পর্কেও মন্তব্য করেছেন যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক ছিলেন।”

“এমন মন্তব্যের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কাউকে বরখাস্ত করতে পারে না। তবে প্রশাসনিকভাবে যে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেটা আমরা নেব,” বলেন তিনি।

এর আগে গত ১৪ জুন প্রায় একই ধরনের অভিযোগে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বাংলা বিভাগের প্রভাষক সিরাজাম মুনিরাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া দুইটি মামলার বাদী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রলীগ সভাপতি তুষার কিবরিয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কর্নেল (অব.) আবু হেনা মোস্তফা কামাল। গ্রেপ্তারের পর তাঁকে সাময়িক বহিষ্কারও করা হয়েছে।

গত ১৩ জুন সকালে ঢাকার শ্যামলীতে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম। রক্তচাপজনিত সমস্যা নিয়ে পহেলা জুন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। সেদিনই তাঁর করোনা শনাক্ত হয়।

পরে করোনামুক্ত হলেও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে দ্রুত অস্ত্রোপচার করে তাঁকে আইসিইউতে রাখা হয়। ওই অবস্থা থেকে আর ফেরেননি এই আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি অসুস্থ হওয়ার পরপরই ১ ও ২ জুন তাঁকে উদ্দেশ্য করে ফেসবুকে লিখেছিলেন রাবি শিক্ষক জাহিদুর।

সে সময় কিছু না ঘটলেও শনিবার নাসিমের মৃত্যুর পর বিরূপ মন্তব্য করে সেদিনই বেরোবির শিক্ষক মুনিরা গ্রেপ্তার হন।

এরপরেই জাহিদুরের সেই লেখা সামনে এনে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে উপাচার্য এম আব্দুস সোবহানের কাছে স্মারকলিপি দেয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। এরই প্রেক্ষিতে বুধবার তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়।

সমালোচনায় মুখর বিশ্লেষকরা

ফেসবুকে সামান্য সমালোচনার জেরে করোনা মহামারির মধ্যেও এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গ্রেপ্তার হওয়ার সমালোচনা করেছেন বিশ্লেষকেরা। সরকারের নানা অনিয়ম ঢাকতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার চলছে বলেও দাবি তাদের।

মামলা হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শিক্ষক জাহিদুর রহমানকে রাতের অন্ধকারে গ্রেপ্তারের বিষয়টি উল্লেখ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন বেনারকে বলেন, “সাধারণত মামলার হওয়ার পরপরই আটক করা হয় তাঁদের, যাদের পলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাঁর ক্ষেত্রে এই আশঙ্কা অন্তত ছিল না।”

“এই করোনাকালেও নানা দুর্নীতি হচ্ছে। সেসব নিয়ে যাতে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে তার পূর্ব-সতর্কতা হিসেবে শুধুমাত্র সমালোচনার কারণে এসব শিক্ষকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে,” বলেন আবদুল্লাহ আল মামুন।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিনের দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল বেনারকে বলেন, “শুধুমাত্র ফেসবুক পোস্টের কারণ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক হওয়া অপ্রত্যাশিত ব্যাপার। রাজা যা বলে পেয়াদারা তার চেয়ে বেশি লাফায়, এক্ষেত্রেও এটাই হয়েছে। নয়ত এত উত্তেজিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।”

বিতর্কিত আইনে মামলা বেড়েছে

আর্টিকেল নাইনটিনের দাবি, করোনা মহামারির এই সময়ে দেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা বেড়েছে। করোনার চার মাসেই ৮০টির বেশি মামলা হয়েছে।

ফারুক ফয়সাল জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে মত প্রকাশের অধিকার লঙ্ঘনের কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৮৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মার্চে ১৩টি, এপ্রিলে ২৪টি এবং শুধু মে মাসে অন্তত ৩০টি মামলা হয়েছে। এছাড়া জুনের ১৪ তারিখ পর্যন্ত আরো ১৩টি মামলা হয়েছে।

“জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত হওয়া ৮৫টি মামলায় অন্তত ১৬২ জন অভিযুক্ত হয়েছে। যার মধ্যে ৩৮ জনই সাংবাদিক,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।