গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান
2020.07.20
ঢাকা
ভিন্নমত দমন কিংবা জুলুম চালানোর জন্য করোনাভাইরাসকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার না করতে বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
সোমবার এক বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় গণতন্ত্র, সুশাসন এবং মানবাধিকারের বিষয়ে মনোনিবেশ করতে আহ্বান জানায়।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ বলেও সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে ওই বিবৃতিতে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মুক্ত গণমাধ্যমের নিশ্চয়তা বিধানের বিষয়েই বেশি জোর দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকারের সমালোচনা করার কারণে বাংলাদেশ সরকার সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট, ডাক্তার, গবেষক এবং অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করছে। তাই পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মুক্ত গণমাধ্যমের বিষয়ে জোর দিচ্ছে।”
“যুক্তরাষ্ট্র সরকার কোভিড ১৯ মহামারিতে গণতান্ত্রিক মানদণ্ড এবং কর্তৃত্ববাদী প্রতিক্রিয়াগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপাক্ষিক কূটনীতি, বৈদেশিক সহায়তা এবং অন্যান্য বিদেশ নীতি ব্যবহার করে,” বলা হয়েছে বিবৃতিতে।
তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিবৃতি পড়েননি বলে বেনারকে জানান তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
তিনি বলেন, “আমি তাদের বিবৃতি এখনো দেখিনি। কাল (মঙ্গলবার) অফিসে গিয়ে বিবৃতি দেখব, পড়ব এবং তারপর এসব বিষয়ে মন্তব্য করব।”
তবে আইনটি বাতিল করার কোনো প্রয়োজন দেখছে না সরকার।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গত ১ জুলাই বেনারকে বলেন, “আমরা মনে করি না ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার প্রয়োজন আছে। এই আইন নাগরিকদের অনলাইনে সম্মানহানি থেকে রক্ষা করতে প্রণয়ন করা হয়েছে।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের অভিযোগও নাকচ করে দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সোমবার দেওয়া যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এই বিবৃতিতে বাংলাদেশ ছাড়াও আজারবাইজান, বলিভিয়া, কঙ্গো, এল সালভাদর, গিনি, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, সিরিয়া, কসোভো, মালি, মলডোভা, রাশিয়া, ইউক্রেইন এবং উজবেকিস্তানের মিডিয়া, গণতন্ত্র, সুশাসন এবং মানবাধিকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলা ও গ্রেপ্তারে উদ্বেগ
প্রায় তিন মাস রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দেশ অবস্থায় থাকার পর গত দুই মাস ধরে বিনা বিচারে কারাভোগ করছেন সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্তত তিনটি মামলায় তাঁকে জেলখানায় রাখা হয়েছে।
“সরকার পক্ষের জোরালো আপত্তির কারণে বাবাকে আদালত জামিন দেয়নি,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন কাজলের ছেলে মনোরম পলক, যিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
পলক বলেন, “এই করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে তিনি জেলে আছেন। তিনি এই ভাইরাস থেকেই বা কতটুকু নিরাপদ? পরিবারে আমরা সবাই তাঁকে নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি।”
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. সোহেল রানা গত ১ জুলাই বেনারকে বলেছিলেন, “গত বছর এই আইনে ৭৩২টি মামলায় এক হাজার ১৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আর চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৩৩৯ জন। দুই মাসে মোট মামলা হয়েছে ১৬৫টি।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একের পর এক মামলায় উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা।
গত ৩০ জুন এক বিবৃতিতে দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ বলেছে, “করোনাকালে এখন পর্যন্ত ৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে ৩৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
“এর ফলে অবাধ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে,” উল্লেখ করে আইনটি বাতিলের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন সম্পাদকেরা।
এছাড়া, জাতিসংঘের একটি ফাঁস হওয়া নথির ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন প্রকাশের দায়ে গত মার্চের শেষ দিকে বাংলাদেশে বেনারনিউজের ওয়েবসাইট ব্লক করে দেয়া হয়।
জাতিসংঘের ওই নথিতে আশঙ্কা করা হয়েছিল, সঠিক পন্থা গ্রহণ না করলে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারিতে প্রায় বিশ লাখ পর্যন্ত মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
এর পর থেকেই বাংলাদেশের পাঠকরা আর বেনারনিউজের সাইটে ঢুকতে পারছেন না।
মানবাধিকার কর্মী এবং আর্টিকেল-১৯ এর বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ফারুখ ফয়সাল সোমবার বেনারকে বলেন, “কোভিড ১৯ নিয়ে যা হচ্ছে, তাতে এই সরকারের মুখ লুকানোর আর কোনও জায়গা নেই। কোভিড ১৯ নিয়ে দুর্নীতিতে সরকারের সংশ্লিষ্টতা এখন স্পষ্ট। সরকার এখন মিডিয়ার মুখ বন্ধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।”
রোহিঙ্গা শিবিরের ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গ
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ইন্টারনেট প্রতিবন্ধকতা প্রত্যাহারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ রাষ্ট্রদূত স্যাম ব্রাউনব্যাকের আগের আহ্বানের প্রসঙ্গটি সোমবারের বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর।
এ প্রসঙ্গে “বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে,” জানিয়ে ফারুখ ফয়সাল সোমবার বেনারকে বলেন, “কিন্তু শরণার্থীদেরও যে যোগাযোগের প্রয়োজন আছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।”
তিনি বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে এই যোগাযোগের সুযোগ দেওয়া আরও বেশি জরুরি। কারণ মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট যোগাযোগ তাঁদের প্রাণ রক্ষায় সহায়ক হবে।”
বিলম্ব না করে শরণার্থীদের জন্য ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ অবারিত করা উচিত বলে মনে করেন ফারুখ ফয়সাল।
প্রসঙ্গত, ‘নিরাপত্তা’র অজুহাতে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাংলাদেশ সরকার।