এক দশক পর আইএমএফের কাছে ঋণ চাইলো বাংলাদেশ

আহম্মদ ফয়েজ
2022.07.27
ঢাকা
এক দশক পর আইএমএফের কাছে ঋণ চাইলো বাংলাদেশ ঢাকার বায়তুল মোকাররম এলাকার একটি মানিএকচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানে ডলার গুনছেন এক ব্যক্তি। ১৯ জুলাই ২০২২।
বেনারনিউজ

চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। এর অন্যতম কারণ সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ব্যাপকভাবে কমেছে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পেয়েছে।

যদিও এর আগে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রথমে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ঋণদাতা আইএমএফের কাছে ঋণ চাইবে না।

এখন তিনি বলছেন, আইএমএফকে ঋণের জন্য আলোচনা শুরু করতে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে শর্তাবলী গ্রহনযোগ্য হলেই এই ঋণ গ্রহণ করবে বাংলাদেশ। গত সপ্তাহে আইএমএফের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেছে। তবে দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনও তথ্য জানানো হয়নি।

শর্ত এবং ঋণের পরিমাণ সম্পর্কে কোনও তথ্য না দিয়ে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, “পরিস্থিতি অনুযায়ী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা করা হয়ে থাকে। সরকার যদি ডিমান্ড এক্সপোজ করে দেয়, তাহলে ঋণের শর্ত-সুদ নিয়ে দরকষাকষিতে সরকার শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে না। সেজন্য এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করে কিছু বলা হয়নি।”

আইএমএফ কী ধরনের শর্ত দেয়, সেগুলো দেশের পক্ষে যাবে কিনা এবং উন্নয়ন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা-সেসব বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে যেভাবে নির্ধারিত সুদের হার রয়েছে, প্রয়োজনে তাতে পরিবর্তন আনার আভাস দিয়ে মন্ত্রী বলেন, “নির্ধারিত সুদ হারের কারণে দেশের অর্থনীতি ভালো আছে। এই সুদ হার যদি না থাকতো তাহলে করোনার সময়ে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হারিয়ে যেত। ফলে এটি অনেক ভালো সিদ্ধান্ত। তবে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দরকার হলে সরকার তা করবে।”

সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী কত টাকা ঋণ চাওয়া হচ্ছে সে সম্পর্কে কোন ধারণা না দিলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন যে, সরকার সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে আগ্রহী।

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে আইএমএফের কাছে একটি ই মেইল পাঠিয়ে কোন জবাব পায়নি বেনার নিউজ।

অর্থ মন্ত্রনালয়ের ওই কর্মকর্তা জানান, আমদানির বিপরীতে মূল্য পরিশোধ ও বাজেট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই ঋণ নিতে চায় বাংলাদেশ।

“আমরা সতর্ক থাকব যাতে কোনো শর্ত আমাদের বিরুদ্ধে না যায়। পরিমাণটা আমরা বলিনি। আমরা আগে তাদের অবস্থা দেখব। যদি তারা ইতিবাচকভাবে আমাদের উপকার করে, তবে আমরা এটি বিবেচনা করব,” যোগ করেন মন্ত্রী।

“বিদেশী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশ একটি ভালো বাজার। বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের পদ্ধতি খুবই ভালো এবং খুবই সহজ,” বলেন তিনি।

তিনি বলেন, সরকার সবসময় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং জাইকার মতো দাতাদের কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করে।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ দেশের অর্থনীতিকে নতুন চ্যালেঞ্জে ঠেলে দেয়ার প্রেক্ষিতে গত এক দশকের মধ্যে এই প্রথম বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ঋণের অনুরোধ করল।

এর আগে বাংলাদেশ ২০১২ সালে আইএমএফের কাছে থেকে ৯৮৭ মিলিয়ন ডলারের ঋণ নিয়েছিল।

ডলারের বাড়তি দাম চাপ বাড়াচ্ছে রিজার্ভে

বাংলাদেশ এমন সময়ে আইএমএফের কাছে ঋণের জন্য অনুরোধ করে যখন দেশটি চাপের সম্মুখীন। মঙ্গলবার দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯.৬১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে যা গত বছরের আগস্টে ছিলো ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শেষবার বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে (৩৯.৭৮ বিলিয়ন ডলার) এসেছিল ২০২০ সালের অক্টোবরে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে, জুনে দেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা আগের বছরের একই মাসে ছিল ৫.৬৪ শতাংশ। এটি ২০১৪ সালের পর সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতির হার।

মুদ্রাস্ফীতি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার ক্রমান্বয়ে অবনমন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, সরকার ডলার ছাপায় না, বরং অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স ও রপ্তানি প্রাপ্তির মাধ্যমে অর্জন করতে হয়।

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কেউ কেউ আমদানির মাধ্যমে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে অভিযোগ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি বাজার যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, বিনিময় হারের বাজার চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া উচিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, ব্যাংকগুলোকে ডলারের চাহিদা মেটাতে সহায়তা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোমবার ১৩২ মিলিয়ন ডলারের পর মঙ্গলবার বাজারে ৫০ মিলিয়ন ডলার ছেড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমান অর্থ বছরের প্রথম ২৬ দিনে আমদানি ব্যয় প্রদানের বাধ্যবাধকতা নিষ্পত্তির জন্য তারল্য সহায়তা হিসাবে সরাসরি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলিতে রিজার্ভ থেকে ৯৯০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে।

এদিকে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিদ্যমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে বাংলাদেশ ছয় থেকে নয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম হবে।

“যেকোনো সংকটের সময় কমপক্ষে তিন মাসের জন্য খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য (প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র) আমদানি করার জন্য আমাদের হাতে অর্থ রয়েছে। আমাদের এখন যে রিজার্ভ আছে তা দিয়ে আমরা কেবল তিন মাসের জন্য নয়, ছয় থেকে নয় মাসের জন্য খাদ্য আমদানি করতে পারব,” বলেন প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ রিজার্ভ থেকে অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রে অধিকতর সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

বেনারের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, “স্থানীয় উৎপাদনভিত্তিক বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা মেটাতে না পারায় বাংলাদেশ এ অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় পণ্য আমদানি কমাতে সংশ্লিষ্টদের মনোযোগী হতে হবে।”

আইএমএফের ঋণ সম্পর্কে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বেনারকে বলেন, আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার পদক্ষেপকে তিনি ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

“অর্থ দেওয়ার পাশাপাশি, আইএমএফ অর্থনীতির সংস্কারের জন্য কিছু শর্তও দেবে। আমি নিশ্চিত এসব শর্ত অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে,” বলেন সাবেক এই আইএমএফ কর্মকর্তা।

জ্বালানির কোনও সংকট নেই: বিপিসি

দেশে জ্বালানি তেলের কোনো সংকট নেই এবং আগামী ছয় মাসের তেল সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমদানি শিডিউল করা আছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ। বুধবার দুপুরে বিপিসির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে একথা জানান তিনি।

এসময় বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, “পেট্রোল পাম্পগুলোয় গ্রাহকদের কম তেল দেয়ার কোনও নির্দেশনা দেয়া হয়নি। বাংলাদেশে যে পরিমাণ তেল রয়েছে এবং আমদানি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, তাতে ছয় মাসের জ্বালানি নিশ্চিত। আর তেল আমদানি না করলেও দেশে ৩২ দিনের ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল রয়েছে।”

আগামী ৩০ জুলাই দেশে আসবে আরো ৩০ হাজার মেট্রিকটন ডিজেল। এর বাইরে ৪৪ দিনের জেট ফুয়েল রয়েছে বলেও জানান তিনি।

জ্বালানি তেলের আমদানি, মজুদ ও সরবরাহ করার প্রক্রিয়াগুলো স্বাভাবিক রয়েছে। আগামী ছয় মাস এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া চলবে জানিয়ে তিনি বলেন, “যে পরিমাণ জ্বালানি মজুদ রয়েছে, তা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।”

এদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে, ৪ লাখ ৩১ হাজার ৮৩৫ টন ডিজেলের মজুদ রয়েছে, যা ৩২ দিনের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাবে। কারণ প্রতিদিন ১৩ হাজার ৬০৭ টন ডিজেলের চাহিদা রয়েছে।

গত এক সপ্তাহে জ্বালানি সংকটের কারণে এলাকাভিত্তিক বিদ্যুত বন্ধ রাখছে সরকার।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, দ্রুত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ আইন বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করেছে। আইন করে দায়মুক্তি দেওয়ায় আমলারা কোনো ভয় ছাড়াই দুর্নীতিতে লিপ্ত হন এবং পরিচালনায় ব্যর্থ হন।”

এই অভিযোগ সম্পর্কে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান বেনারকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। এর সঙ্গে অন্য কিছু মেলানো মোটেও উচিত হবে না বলে মনে করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।