বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের উপকূলীয় এলাকার মানুষদের প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে মোকাবেলা করতে হয় জলবায়ু পরিবর্তনের দুর্ভোগ। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত, তেমনি লোনাপানি কারণে বিভিন্ন রকমের বাধার মুখে পড়ছে তাঁদের জীবন ও জীবিকা। সাতক্ষীরা অঞ্চলের জীবনযাত্রায় লোনাপানির প্রভাবের ওপর বেনারনিউজের এই বিশেষ প্রতিবেদন।

- বিপর্যস্ত উপকূলীয় জীবন

- বাড়ছে বাল্যবিয়ে

- জরায়ু ফেলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন নারীরা


লোনাপানিতে বিপর্যস্ত উপকূলের জীবন

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাড়ছে সমুদ্রের লোনাপানি, লোকালয়ে ঢুকে তৈরি করছে খাবার পানির সংকট, বিলীন হচ্ছে কৃষিনির্ভর জীবিকা।

জেসমিন পাপড়ি, সাতক্ষীরা

“লোনা পানি আমাদের সবকিছু শেষ করে দিয়েছে,” বিলীনপ্রায় সবজি বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন সালেহা খাতুন। একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে বসতবাড়ির এক টুকরো জমিতে কুমড়া, লাউ, ডাটা, ঢেঁড়স, পুঁই, কলমি শাকসহ অন্যান্য সবজি লাগিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মাদার নদীর লোনা পানি ঢুকে সবজি বাগানসহ তাঁর কুঁড়েঘরের দেয়ালও নষ্ট করে দিয়েছে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বৈশখালী গ্রামের সালেহাদের চারপাশ পানি দিয়ে ঘেরা থাকলেও সুপেয় পানির তীব্র কষ্টে ভুগতে হয় তাঁদের।

“খাওয়ার পানির প্রচণ্ড কষ্ট। ৩০ লিটার পানি ২০ টাকা দিয়ে কিনে খেতে হয়। তিন জনের সংসারে পানি থেকে শুরু করে সবকিছু কিনে খাওয়া কঠিন। তার ওপর বছরে দুই-তিনবার ঘর ভাঙে। এভাবে কতদিন বাঁচা যায়?” বলছিলেন স্বামী হারানো সালেহা।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর, কালিগঞ্জ এবং খুলনার কয়রা উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে বেনার প্রতিবেদক সালেহা খাতুনের মতো অনেকের সাথে কথা বলেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের নানারকম দুর্ভোগ মোকাবেলা করছে এইসব উপকূলীয় এলাকার মানুষ। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে তাঁরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি লোনাপানি বাড়ার কারণে বিভিন্ন রকমের বাধার মুখে পড়ছে তাঁদের জীবন ও জীবিকা।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে বসতি এলাকায় লোনাপানি ঢুকে মিঠা পানির উৎস আর কৃষিজাত ফসল দুটোকে বিলীন করে দিচ্ছে, যা সরাসরি হুমকি হয়ে উঠছে ওইসব এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে।

উন্নয়ন সংস্থা ওয়াটার এইডের ২০১৯ সালের একটি গবেষণামতে, গত ২৫ বছরে বাংলাদেশে লোনাপানির অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ, পাশাপাশি প্রতি বছর উপকূলের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পরিমাণ বেড়েই চলেছে।

বাড়ির উঠানে নিজের বাগান থেকে লাউর ডগা তুলছেন সাতক্ষীরা শ্যামনগরের পরানপুর গ্রামের রওশন আরা বেগম। লোনাপানির কারণে বছরের অন্য সময় কোনো গাছ হয় না বলে শুধু বর্ষাকালেই তিনি সবজি চাষ করতে পারেন। ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১। [জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ]

পানি আর জ্বালানি কিনে ‘বাঁচা কষ্ট’

সালেহা খাতুনের মতো এসব এলাকার বাসিন্দারা খাওয়া ও রান্নার প্রয়োজনসহ দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে সুপেয় পানিরও তীব্র সংকটে ভুগছেন। একই সাথে লোনাপানি ঢুকে কৃষি জমির ক্ষতি ও সেচের উপযোগী পানির অভাবে খাদ্য ও স্থানীয় আয়ের উৎসও হারিয়েছেন তাঁরা।

“পানির কষ্টের কারণে মেয়ের বিয়ে পর্যন্ত দিতে পারি না। কারণ, এই এলাকায় কেউ বিয়ে করতে চায় না। বৃষ্টির মৌসুম ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় খাবার পানি কিনেই খেতে হয়,” বেনারকে বলেন বৈশখালী গ্রামের আরেক নারী রোমেছা বেগম (৪০)।

ফেরিওয়ালা স্বামীর দিনে ৩০০ টাকার মতো আয় হয় জানিয়ে তিনি বলেন, চাল, পানি থেকে শুরু করে জ্বালানি পর্যন্ত কিনতে হয়। এভাবে বেঁচে থাকা খুব কষ্টকর।”

“আরেক গ্রাম থেকে রান্নার পানি আনতে হয়। কিন্তু তারাও ধান চাষের জন্য মিঠা পানি সংরক্ষণ করে বলে পানি দিতে চায় না, এ জন্য কটু কথা শোনায়,” বলেন রোমেছা।

২০১৩ সালে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, সাতক্ষীরার বাসিন্দাদের প্রায় ৭০ শতাংশ দূরবর্তী পুকুরের পানির উপর নির্ভরশীল।

দূর থকে পানি আনার কাজ সাধারণত মেয়েরাই করেন। স্থানীয় নারীরা বেনারকে জানান, পরিবারের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করতে প্রতিদিন তাঁদের দুই থেকে পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে যেতে হয়।

শুকনো এবং বৃক্ষহীন এলাকা মধ্যে দিয়ে গ্রামের মহিলারা কাঁখে পানির কলসি নিয়ে ফিরছেন- উপকূলীয় জেলাগুলোতে এ এক সাধারণ দৃশ্য। এই অঞ্চলটি বিশ্বের বৃহত্তম লোনাপানির বন বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের একেবারে কাছে।

এসব এলাকার রাস্তাঘাট অধিকাংশই কাঁচা, ফলে চলাচলেও অত্যন্ত কষ্ট করতে হয় সাধারণ মানুষকে।



কাজের সন্ধানে পুরুষরা ছাড়ছেন গ্রাম

লবণাক্ততার কারণে কৃষি জমি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পুরুষদের বড়ো একটি অংশকে পরিবার ছেড়ে শহরে কাজ করতে যেতে হয়। যাদের সে সামর্থ্য নেই, তাঁরা গ্রামে অলস সময় কাটান।

বিশ্বব্যাংকের ২০১৪ সালে পরিচালিত সমীক্ষা অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে নদী ও ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাবে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে পানীয় জল ও সেচের ঘাটতি বাড়বে, যা প্রায় ২৯ লাখ দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা অ্যাডভান্সিং আর্থ অ্যান্ড স্পেস সায়েন্সের গত বছর প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ অভিবাসী বা স্থানান্তরিত হবেন। নিম্নভূমির দেশ হওয়ার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ বিশেষভাবে সংবেদনশীল বলে জানানো হয় ওই প্রতিবেদনে।

কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকে গ্রামে পরিবার রেখে দূরে কাজে যান। এদেরই একজন গাবুরার বাসিন্দা শেখ আবদুল বারী, যিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ইটের ভাটাগুলোতে সর্দার হিসেবে কাজ করেন।

“গ্রামে কোনো কাজ নেই। লবণাক্ততা এখানে উপার্জনের সব সুযোগ নষ্ট করে দিয়েছে। তাই অধিকাংশ সক্ষম পুরুষ কাজ করতে অন্য জেলায় যায়,” বেনারকে বলেন আবদুল বারী।

কয়রা উপজেলার কয়রা ইউনিয়নের সুবলা রানী বেনারকে জানান, ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ভাঙনে ঘর ভেসে যাওয়ার পরে পরিবার নিয়ে দুই ছেলের একজন রাঙ্গামাটি অন্যজন খুলনার দাকোপে চলে গেছে।

ছেলেদের বোঝা বাড়াবেন না বলে তিনি থেকে গেলেও সংসার চালাতে অত্যন্ত কষ্ট হয় বলে জানান।

পুরুষদের যারা গ্রামে থেকে যান, তাঁদের অনেকেই জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষি বা মৎস্য চাষে কাজ করেন।

এখনও পানি সরবরাহে লবণাক্ততার ক্রমবর্ধমান মাত্রা অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে প্রভাবিত করছে, কারণ কিছু গ্রামবাসী চিংড়ি বা কাঁকড়ার ঘের করছে।

“আমাদের সব সমস্যার মূল হলো লোনাপানি। ঘূর্ণিঝড় আইলার (২০০৯) পর থেকে লোনাপানি ধীরে ধীরে এই এলাকাকে মরুভূমি বানিয়ে দিয়েছে,” বলছিলেন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার নয় নম্বর সোরা গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (৫৬)।

“যেটুকু অল্প জমি ছিল তাতে একসময় ধান লাগাতাম। পুকুরে মাছ হতো। এখন লোনাপানির কারণে ধান চাষ করা যায় না। সবকিছু কিনে খেতে হয়, খাবার পানিও। গরু-ছাগল কিংবা হাঁস-মুরগিও পুষতে পারি না,” বলেন মাহবুবুর রহমান।

সাতক্ষীরা শ্যামনগরের যাদবপুরে মায়ের সাথে বাড়ি ফিরছে তিনটি শিশু। ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১। [জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ]

সমস্যা বাড়াচ্ছে মাছের ঘের

জয়াখালী গ্রামের মোহাম্মদ আলীমউদ্দিন গাজী (৫৮) বলেন, “আমার এই ৫৮ বছর বয়সে এত পানির কষ্ট কখনো পাইনি।”

চিংড়ি চাষের ঘেরের কারণে লবণাক্ততার তীব্রতা আরো বেড়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “লোনাপানির কারণে গাছপালা সব মরে এই এলাকা মরুভূমির মতো হয়ে যায়। ঘের না থাকলে গাছপালা জন্মাবে। ফসল ফলানো যাবে। গরু ছাগল পোষা যাবে। মানুষের অভাব কমবে।”

লবণাক্ততা বৃদ্ধির জন্য শুধু জলবায়ু পরিবর্তন নয়, মাছের ঘের তৈরির মতো মনুষ্যসৃষ্ট কারণকেও দায়ী করেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ। উপকূলীয় এলাকায় ঘের বন্ধ করতে পারলে এই ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমে আসবে মনে করেন তিনি।

২০১৪ সালের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলে চিংড়ি চাষ স্থানীয় পরিবেশগত মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে; যার মধ্যে রয়েছে মাটি এবং পানির গুণমানের অবনতি, ভূগর্ভস্থে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ, স্থানীয় পানি দূষণ এবং স্থানীয় হাইড্রোলজি পরিবর্তন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের গবেষণায় বলা হয়েছে, “গবেষণা এলাকায় লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ স্থানীয় গাছপালা এবং বিশেষ করে ধান ও শাকসবজি উৎপাদনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।”

দেশের জনসংখ্যার আনুমানিক ৪১ ভাগ মানুষ সমুদ্রপিঠ থেকে ১০ মিটার (প্রায় ৩২ ফুট) নিচে বসবাস করেন বলে জানানো হয় ওই প্রতিবেদনে।

সরকারের একজন কর্মকর্তা অবশ্য বলেছেন, সরকার উপকূলীয় লবণাক্ততার সমস্যা সমাধান করছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ মোহসীন বেনারকে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে। এর প্রেক্ষিতে সরকারের সুপেয় পানির জন্য প্রকল্প আছে।”

“সমুদ্রের পানিকে সুপেয় করে অথবা জলাধারের পানি করে মানুষকে সরবরাহ করা হচ্ছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “পানির চাহিদা অনেক; এটি বিবেচনা করে এ ধরনের আরো বড়ো প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।”

“এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকায় লবণ সহনশীল ধান বা ফসল চাষ করা হচ্ছে। লবণাক্ত পানি রোধ করতে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে,” বলেন মো. মোহসীন।

দুর্যোগ সচিব বলেন, “ইতিমধ্যে আমরা লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং নদী ভাঙনের কারণে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন কর্মকৌশল প্রণয়ন করেছি। এখন আমরা কোন মন্ত্রণালয়ের, কী দায়িত্ব সেটা নির্ধারণের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে শেয়ার করে—কোথায় তাদের ইনটারভেনশন দরকার, সেটা জানার চেষ্টা করছি।”



সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার শৈলখালী গ্রামে শ্বশুর বাড়ির সামনে নিজের শিশুসন্তান কোলে কিশোরী মা আন্না খাতুন। ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১। [জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ]

জলবায়ু পরিবর্তন ও দারিদ্র: উপকূলীয় অঞ্চলে বাড়ছে বাল্যবিয়ে

মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বোঝামুক্ত হতে চান অভিভাবকরা, সাতক্ষীরার অনেক গ্রামেই অবিবাহিত কোনো কিশোরী নেই।

জেসমিন পাপড়ি, সাতক্ষীরা

করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকার সময় বাড়ির কাজ আর খেলাধুলা করেই কাটছিল আন্না খাতুনের (১৩) দিন। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় আন্নাকে আত্মীয়ের বাড়িতে নেওয়া হয়, আন্না জানতে পারে একটু পরেই তার বিয়ে।

বছর না ঘুরতেই একটি সন্তানও জন্ম দেয় ওই কিশোরী। বাল্যবিয়ের শিকার আন্নার জন্ম দেওয়া শিশুটির বয়সও এখন প্রায় তিনমাস।

“আমি বুঝতে পারছিলাম না হঠাৎ করে কী ঘটল। বিয়ের পরে আর খেলাধুলা করা হয়নি, সারাক্ষণ সংসারের কাজ আর কাজ। এমনকি আমি গর্ভবতী অবস্থায়ও কাজ করেছি,” বলছিল সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার শৈলখালী গ্রামের এই কিশোরী।

বাল্যবিয়ের এই চিত্র বাংলাদেশের দুর্যোগ-প্রবণ উপকূলীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম খুলনা এলাকায় খুবই সাধারণ। দারিদ্র্য এবং অন্যান্য নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাল্যবিবাহের সংখ্যা প্রতিনিয়ত এ অঞ্চলে বাড়ছে। করোনা মহামারির সময়ে সেটা বহুগুণে বেড়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম সাতক্ষীরা জেলায় বাল্যবিয়ের ঘটনা প্রায় ঘরে ঘরে।

শ্যামনগর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, উপজেলার ৮৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট ১,২১৪ জন মেয়ে শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে। এদের মধ্যে ৭০৩ জন মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, ৫১১ জন বিভিন্ন মাদ্রাসার এবং ৩৩৩ জন বিভিন্ন কলেজের। তবে স্থানীয়রা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের এই তালিকা অনুযায়ী, পরানপুর এ রউফ মেমোরিয়ালে করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকার সময় কোনো শিক্ষার্থীর বাল্য বিয়ে হয়নি। তবে স্কুলটির একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানান, এই সময়ে মোট ১৯০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৪ জন মেয়ে শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে। যাদের বয়স ১২-১৬ বছর।

মহামারির মধ্যে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী সুবর্ণা ইয়াসমিন হীরার। কয়েকমাসের মধ্যেই তার বিচ্ছেদও হয়। বাবার বাড়িতে ফিরে এসে আবারও পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ থাকলেও অভাবের কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানায় সে।

হীরা জানায়, তার ক্লাসে ৬৫ জন শিক্ষার্থী ছিল। করোনার পর জানা যায় তাদের মধ্যে ১২ জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে।

খুলনার কয়রার একটি স্কুলের দশম শ্রেণির প্রেমা মণ্ডল বলেন, “করোনার পর স্কুল খুললে জানা গেলো করোনাকালে আমাদের ক্লাসের ১৪ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু আমি পড়তে চাই।”

বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে মেয়েদের এবং ২১ বছরের আগে ছেলেদের বিয়ে করা বেআইনি। তবে বাল্যবিয়ের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৫১ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়। এর মধ্যে প্রায় ১৮ শতাংশের বিয়ে হয় ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই।

করোনা মহামারির কারণে স্কুল বন্ধ, বাড়ির পাশে মার্বেল খেলছে দুই শিশু। [জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ]

বাল্যবিয়ে নতুন নয়

মাত্র ১৩ বছর বয়সে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার অভিজ্ঞতা আন্নার পরিবারের জন্য নতুন নয়। তার অন্য তিন বোনেরও এরকম বা এর চেয়ে কম বয়সে বিয়ে হয়েছে। তাঁরাও কম বয়সে মা হয়েছেন এবং নানা শারীরিক জটিলতায় পড়েছেন।

“আমরা গরিব মানুষ। বেশিদূর তো পড়ালেখা করাতে পারব না। ভালো পাত্র পেয়েছি বলেই দেরি না করে বিয়ে দিয়েছি,” বেনারকে বলেন আন্নার মা হাসিনা বেগম।

সরকারি তথ্য অনুসারে করোনা মহামারি দেশে প্রায় ২৫ লাখ মানুষকে নতুন করে দরিদ্র করেছে। এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা এবং দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমকে বেড়েছে।

শৈলখালী গ্রামটি ঘুরে ১৬-১৭ বছর বয়সী কোনো অবিবাহিত কিশোরী খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর আগেই তাদের বিয়ে হয়ে যায়।

“আমার এলাকায় ১৪ বছরের বেশি বয়সী কোনো অবিবাহিত মেয়ে নেই, কারণ বেশিরভাগ বাবা-মা বিভিন্ন কারণে তাঁদের মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করছেন,” বেনারকে বলেন শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জি.এম. মাসুদ আলম।

তবে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা বাল্যবিবাহ বন্ধে কাজ করছেন বলে জানান তিনি।

দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরায় একটি বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত ভাসমান স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের নার্স ববিতা পারভীন বেনারকে বলেন, “এই এলাকায় বাল্যবিবাহ অত্যধিক বেশি। এরপর মেয়েরা অল্পবয়সে মা হয়ে যায়। তারা অত্যন্ত পুষ্টিহীনতায় ভোগে। পূর্ণ বয়সে মা না হওয়ায় অল্পবয়সী এসব মায়েরা নানারকম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে।”

২০০৭ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য জরিপের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা বিভাগে বাল্যবিবাহের হার সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ।

স্থানীয়রা জানান, উপকূলীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলায় বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির একটি বড়ো কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রজনন ক্ষমতা হারানোর ভয়। কারণ লবণাক্ততার কারণে এই এলাকায় মেয়েদের অনেককে অল্পবয়সে জরায়ু অপসারণ করতে হয়।

“আমাদের স্কুল থেকে ছাত্রীদের ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ বাল্যবিয়ে। অধিকাংশ মেয়েকে বিয়ের পর আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে দেওয়া হয় না,” বেনারকে বলেন গাবুরা এপিজি আলিম মাদ্রাসার শিক্ষক আবদুর রহমান।

পরিবারের ‘বোঝা কমানো’

গ্রামবাসী এবং স্থানীয় নেতাদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগও বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণ। নানা সংকটের সময়ে বাবা মায়েরা বিয়ে দিয়ে মেয়েকে অন্য সংসারে পাঠিয়ে নিজেদের বোঝামুক্ত করতে চান।

শ্যামনগরের শৈলখালী মদীনাতুল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষক গোপাল চন্দ্র ঘোষ বেনারকে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব অঞ্চলে অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে। জীবন জীবিকার পরিবর্তন হয়েছে। যারা কৃষিকাজ, মাছ চাষে যুক্ত ছিল তাদের ক্ষতি হয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষ খুবই দরিদ্র।”

“অনেক মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। অভিভাবকরা মেয়েদের বোঝা বলেই মনে করে। তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে পারলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে,” বলেন তিনি।

বাবা মা কাজে, তাই ছোট ভাইকে নিয়েই স্কুলে এসেছে শ্যামনগরের এক শিশু শিক্ষার্থী। [জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ]

“জলবায়ু পরিবর্তন উপকূলীয় এলাকার পরিবারগুলোকে দারিদ্র্যের গভীরে ঠেলে দিয়েছে,” বলে বেনারকে জানান ইউনিসেফ বাংলাদেশের ক্লাইমেট-চেঞ্জ ফোকাল পার্সন ক্রিস্টিন ক্লাউথ।

তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝড় ও বন্যা আরো খারাপ হতে থাকে, যা মানুষের জীবিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে; নিরাপদ পানি, খাবার বা স্কুল পাওয়াকে কঠিন করে তোলে। এসব মোকাবেলায় দুর্ভাগ্যবশত পরিবারগুলো তাদের অল্প বয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দেয়।”

ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রেক্ষাপটে মেয়েরা বাল্যবিবাহ ও পাচারের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে এই ঝুঁকি অত্যন্ত প্রবল।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর বেনারকে জানান, “উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে দুর্যোগের কারণে মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিচের দিকে থাকে। যে কারণে অনেক পরিবার তার মেয়েকে বিয়ে দেওয়াটা নিরাপদ মনে করে।”

“জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা বাল্যবিয়ে ছাড়াও অনেক সামাজিক সূচকে পিছিয়ে রয়েছে,” বলেন তিনি।

“করোনাভাইরাস মহামারির সময়টাতে দীর্ঘ দেড় বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাল্যবিয়ে বহুগুণে বেড়েছে। তবে সার্বিকভাবে আমরা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজ করছি। আইনের প্রয়োগ, সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণসহ মানুষকে সচেতন করতে কাজ করা হচ্ছে,” জানান সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক।

স্থানীয়রা জানান, অভিভাবকদের অনেকেই সবসময় তাঁদের মেয়েদের ‘খারাপ কিছু’ হওয়ার ভয়ে দিন কাটান। কারণ, লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে উপার্জনের প্রধান উৎস কৃষি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেক পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কাজের জন্য জেলার বাইরে অবস্থান করেন।

বাংলাদেশের ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এবং বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি ক্যাথলিক ডি লুভাইনের যৌথ এক সমীক্ষায় এ বিষয়ে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধান থেকে একটি উদাহরণ ব্যবহার করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে দারিদ্র্য এবং চরম আবহাওয়ার প্রভাবের কারণে যৌন হয়রানির হার বেশি। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মেয়েদের যখন বাবা-মা মারা যান বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন তারা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের স্বাধীন কারিগরি উপদেষ্টা প্যানেলের সদস্য ড. আহসান উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “দেশের যে প্রান্তেই দারিদ্রের হার বেশি সেখানেই বাল্যবিয়ের হারও বেশি। কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা–মা যত দ্রুত সম্ভব বৈধভাবে (বিয়ে দিয়ে) পরিবারের বোঝা কমাতে চান।”

“এক্ষেত্রে সোশ্যাল সেফটি নেটের আওতায় এই ধরনের পরিবারগুলোকে সহায়তা করা উচিত। কিন্তু তা হয়নি। ফলে সংকট তীব্র হয়েছে,” বলেন তিনি।

সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাই এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন ড. আহসান উদ্দিন।



সাতক্ষীরার শ্যামনগরে কপোতাক্ষ নদীতে জাল টেনে পোনা ধরছে ১৩ বছরের কিশোরী নাজমুন নাহার স্মৃতি। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১। [জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ]

লবণাক্ত পানি: জরায়ু ফেলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন উপকূলীয় নারীরা

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ত পানির অত্যধিক সংস্পর্শে সংক্রামক রোগ বাড়ছে।

জেসমিন পাপড়ি, সাতক্ষীরা

অনিয়মিত রক্তপাত এবং তলপেটে ব্যথায় দীর্ঘদিন ভুগে ডাক্তারের পরামর্শে বছর চারেক বছর আগে মাত্র ২৬ বছর বয়সে জরায়ু কেটে ফেলেন বৈশখালী গ্রামের ফিরোজা বেগম (৩০)।

তিনি মূলত লিউকোরিয়া রোগে ভুগছিলেন। চিকিৎসকেরা জানান, অন্য কোনো রোগের আশঙ্কা ছাড়াই যোনি থেকে সাদা স্রাব নির্গত হওয়াকেই লিউকোরিয়া বলে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রোগটি প্রাথমিকভাবে ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাবে সৃষ্ট হয়। পুষ্ঠিহীনতার কারণে এটি আরও বেড়ে যায়।

“সাদা স্রাব হতো সবসময়। কিন্তু এটা যে অসুখ তা বুঝতাম না। কারণ, আমার আশেপাশে বহু নারীরই এটা হতো,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা শ্যামনগরের বৈশখালী গ্রামের ৩০ বছর বয়সী ফিরোজা।

“বিয়ের পরের বছর প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। এরপর থেকেই জরায়ুতে জ্বালা-পোড়া ও যন্ত্রণা হতো। ডাক্তার পানিতে নেমে গোসল বন্ধ করতে বলে। কিন্তু সেটা করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় সন্তান জন্মের কয়েক বছর পরে অপারেশন করে জরায়ু ফেলতেই হয়,” বলেন তিনি।

“মাসের পর মাস ব্লিডিং হতো। পেটে অসম্ভব ব্যথা। কাজকর্ম করতে সমস্যা হতো। ডাক্তারও এক সময় বলল, জরায়ু কেটে ফেললে এই সমস্যা থাকবে না। এরপর অপারেশন করি,” বলছিলেন ফিরোজা।

লোনাপানির কারণে গ্রামে ঘাস জন্মায় না, তাই পোষা ছাগলের জন্য পাশের গ্রাম থেকে ঘাস নিয়ে ফিরছেন কয়রার সুবলা রানি। [জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ]

স্থানীয় বাসিন্দা, স্বাস্থ্যকর্মী এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক নারীকে অল্প বয়সে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জরায়ু অপসারণ করতে হচ্ছে। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশের এই অংশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া এবং সে লবণাক্ত পানির অত্যধিক সংস্পর্শের ফলে এই সমস্যা বেড়েই চলেছে।

বেনারনিউজ সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও খুলনার কয়রা উপজেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে জরায়ু সংক্রান্ত রোগে ভুগছেন, এমন অন্তত ৭৫ জন নারীর সাথে কথা বলেন। এদের মধ্যে অন্তত ৩০ জন অপারেশন করে জরায়ু কেটে ফেলেছেন। বাকিরা বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছেন। এছাড়া চর্মজনিত রোগসহ গুরুতর সংক্রামক রোগ তো লেগেই থাকে।

ফিরোজা বেগমের বাড়ির আরেক নারী সদস্য রোমেছা বেগমেরও (৩৫) জরায়ু কেটে ফেলা হয়েছে গত বছর। সম্পর্কে রোমেছা ফিরোজার চাচীশাশুড়ি।

তারা দুজনেই জানান, লোনা পানিতেই গোসলসহ নিত্যদিনের কাজ করতে হয় তাদের। তবে গত কয়েক বছরের তুলনায় পানির লবণাক্ততা বেড়েছে। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে পুকুরের পানির লবণাক্ততা এত বাড়ে যে, মুখে দেয়া যায় না। তবুও এমন পানিতেই গোসল করতে হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিপুল কার্বন নিঃসরণের ফলে বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর বিস্তীর্ণ উপকূলে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করছে। খুলনা-সাতক্ষীরার মতো জেলাগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ আস্তে আস্তে বিপর্যয়ে রূপ নিচ্ছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গোসল, কাপড় ধোয়া, মাছ ধরাসহ দৈনন্দিন নানা কাজে দীর্ঘ সময় অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে উপকূলের নারীদের যোনিপথে সংক্রমণ শুরু হয় যা ধীরে ধীরে জরায়ুর ক্যান্সার পর্যন্ত পৌঁছায়।

২০১৪ সালে প্রকাশিত ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন সমীক্ষার প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে ৮০ শতাংশেরও বেশি নারী এবং কিশোরী তাঁদের মাসিকের সময় পুরানো কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করেন।

২০১৯ সালে প্রকাশিত অন্য একটি গবেষণাতে বলা হয়, “দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার নারী ও কিশোরীরা মাসিকের সময় ব্যবহৃত কাপড় লবণ পানিতে ধুয়ে আবারও সেটি ব্যবহার করেন।”

“এভাবে বারবার লোনা পানিতে মাসিকের কাপড় ধোয়া এবং সেই কাপড়ের ঘন ঘন ব্যবহার মেয়েদেরকে স্বাস্থ্যগত হুমকির মধ্যে ফেলে। এগুলি কখনও কখনও চর্মরোগ এবং অন্যান্য যৌন সমস্যার জন্যও দায়ী,” তিনটি বাংলাদেশি সংস্থা পরিচালিত ওই সমীক্ষায় বলা হয়।

বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার রেশমা আক্তার বলেন, “এখানকার প্রায় প্রতিটি নারী ও শিশু সাদাস্রাব সমস্যায় ভোগে। বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব এবং গোসলসহ দৈনন্দিন কাজে অপরিচ্ছন্ন ও মাত্রাতিরিক্ত লোনা পানির ব্যবহার এর অন্যতম কারণ।”

এ বিষয়ে একমত পোষণ করে সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. হুসাইন শাফায়াত বেনারকে বলেন, উপকূলের গ্রামগুলোতে লোনা পানির কারণে মেয়েদের লিউকোরিয়াসহ সাধারণ পানিবাহিত রোগ এবং চর্মরোগের সংক্রমণ বেশি শোনা যায়।

প্রায় দুই কিলোমিটার দূরের টিউবওয়েল থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করে কলসি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন মুন্সীগঞ্জের কয়েকজন নারী। [মেঘ মনির/বেনারনিউজ]

গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়ার পরিবার কল্যাণ সহকারী মরিয়ম বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে জরায়ু সংক্রান্ত রোগে ভুগতে ভুগতে এক পর্যায়ে ২৪ বছর বয়সী নারীরাও জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছে।”

দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি বলেন, “লবণের জন্য মেয়েদের মাসিক প্রক্রিয়ার ম্যানেজমেন্ট স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। লবণ পানি ব্যবহারের ফলে মেয়েদের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

“সাতক্ষীরা এলাকায় লবণাক্ততা তীব্র হওয়ার ফলে এখানকার বহু নারী জরায়ুতে ইনফেকশন, জরায়ু ক্যান্সারে ভুগছে। এমনকি জরায়ু কেটে ফেলার ঘটনাও প্রতিনিয়ত ঘটছে,” গবেষণার পর্যবেক্ষণ থেকে বলেন তিনি।

জরায়ু কেটে জীবনভর যন্ত্রণা ভোগ

শ্যামনগরের তিনটি বেসরকারি ক্লিনিকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বছরে মোট অপারেশনের প্রায় ১০ শতাংশ রোগীর জরায়ু অপারেশন হয়ে থাকে।

দীর্ঘদিন ধরে জরায়ু জটিলতায় ভুগলে তা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় বলে জানান চিকিৎসকেরা।

শ্যামনগরে অবস্থিত ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে জরায়ুর অসুখের মাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় চারশো নারীর ভ্যাজাইনাল ইনফেকশন অ্যাসেসমেন্ট (ভিআইএ) করা হয়। এদের মধ্যে ৬৭ জনের ক্যান্সারের মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে। পরবর্তী চিকিৎসার জন্য তাদের খুলনা বা ঢাকায় রেফার করা হয়।

শিশুবয়স থেকে দীর্ঘদিন ধরে লিউকোরিয়ার কারণে মূত্রনালির সংক্রমণ, পেলভিস প্রদাহ, বন্ধ্যত্ব এমনকি সার্ভিকাল ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে বলে জানান ডা. তাসনুভা আফরিন। বর্তমানে সুইডেন প্রবাসী এই চিকিৎসক দীর্ঘদিন ধরে শ্যামনগর ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের কাজ করেন।

উপকূলীয় এই এলাকায় কাজ করা অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানান, “সহনীয় পর্যায়ের পরিষ্কার লোনা পানি ক্ষতিকারক নয়। তবে শুকনো মৌসুমে লবণের তীব্রতা বাড়লে তা নারীদের সারভিক্স থেকে জরায়ু পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।”

“এ এলাকার মেয়েরা সাধারণত পুকুরে গোসল করে। অনেকে দীর্ঘসময় ধরে নদীতে জাল টেনে মাছ ধরে। এসব পানি যে শুধু মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ত তা–ই নয়, একই পুকুরে অনেকে গোসল করে, এমনকি কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন নানা কাজও একই পুকুরে করতে হয়।”

জরায়ু অপারেশনের পর থেকে সারা শরীরে অসহনীয় জ্বালাপোড়া অনুভব করেন বলে জানান ফিরোজা বেগম।

দুই সন্তানের মা খাদিজা বেগম (৩২) বলেন, “আগে তো মাসের কিছুদিন শুধু পেটে ব্যথা করতো। অপারেশনের পর এখন সারাক্ষণ গা দিয়ে দাহ (তাপ) ওঠে। জালা-যন্ত্রণা করে। মনে হয়, পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি, তাহলে একটু আরাম পাব।”

ময়মনসিংহ মেডিকেলের ডা. ইশরাত জাহান স্বর্ণা বেনারকে বলেন, “মেয়েদের শরীরে আলাদা হরমোন আছে, যা দিয়ে মাসিক চক্র, মেজাজ, স্মৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু জরায়ু কেটে ফেললে এসব হরমোনের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়। জরায়ুর সাথে আবার ওভারি কেটে ফেললে এসব হরমোনের সোর্স নষ্ট হয়ে যায়।”

“ফলে একজন অল্পবয়সী রোগী যার মেনোপেজ হওয়ার কথা ছিল না, তার জরায়ু ও ওভারি কেটে ফেললে ভয়াবহ সব সিম্পটম হবে। তার তীব্র গরম লাগবে, মনে হবে মরে যাচ্ছে; ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস হবে অর্থাৎ মাসিকের রাস্তা শুকনো হয়ে যাবে, ফলে স্বামীর সাথে শারীরিক সম্পর্কে যেতে পারবে না; কষ্ট হবে। তার হাড় ক্ষয়ে যেতে থাকে। সার্বিক ভালোলাগা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়,” বলেন তিনি।

বেশ কয়েকজন চিকিৎসক বেনারকে বলেন, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এই অঞ্চলে জরায়ুজনিত রোগে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা বেশি।

দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মি বলেন বেনারকে বলেন, “সাতক্ষীরা জেলার নারীদের এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার রয়েছে, যা জরায়ুর ক্যান্সারের একটি ধরন।”

“জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা তীব্র হওয়ার ফলে নারীদের শারীরিক অসুস্থতা বাড়ছে,” নীলোর্মি বলেন।

বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার পানিতে লবণাক্ততার চিত্র

সূত্র: পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার মাটিতে লবণাক্ততার ধরন সম্পর্কিত গবেষণা।


প্রতিবেদন: জেসমিন পাপড়ি
-------------
ছবি: জেসমিন পাপড়ি ও মনিরুল আলম
-------------
ভিডিও: জেসমিন পাপড়ি ও শেলাজ মাহমুদ
-------------
ভিডিও সম্পাদনা: আশীফ এন্তাজ রবি
-------------
প্রতিবেদন সম্পাদনা: সুবেল রায় ভাণ্ডারী, কেইট বেডাল, ইমরান ভিটাচি, মাহবুব লীলেন, পল নেলসন ও এইচ. লিও কিম।
-------------
ওয়েব পেজ তৈরি: মিন-হা লি
-------------
প্রস্তুতকারক: বেনারনিউজ
-------------
© 2022 BenarNews
-------------
ফেসবুক - ইউটিউব - টুইটার