৪০ লাখ বাঙালির ভারতীয় নাগরিকত্ব বাদ

ঝুমুর দেব
2018.07.30
গৌহাটি, ভারত
180730-IN-BD-assam-620.jpg নাগরিকপঞ্জিতে নিজের নাম আছে কি না খুঁজে দেখতে বুর গাঁও গ্রামের একটি নিবন্ধন কেন্দ্রে মানুষের ভিড়। ৩০ জুলাই ২০১৮।
এপি

ভারতের আসাম রাজ্যে প্রায় চল্লিশ লাখ বাঙালিকে অভারতীয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কয়েক প্রজন্ম ধরে ভারতে বসবাস করলেও সোমবার প্রকাশিত জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) থেকে 'অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী' হিসেবে বাদ পড়েছে এইসব মানুষের নাম।

নাগরিকপঞ্জিতে নিজেদের নাম নিবন্ধন করতে ৩ কোটি ২৯ লাখ আবেদকারীর মধ্যে ২ কোটি ৮৯ লাখ মানুষকে তালিকায় রেখে ভারতের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

১৯৫১ সালের পর প্রথমবারের মতো নাগরিকপঞ্জিটি হালনাগাদ করা হলো।

ভারত সরকারের মতে, ১৯৫১ সালের নাগরিকপঞ্জিতে থাকা ব্যক্তি ও তাঁদের বংশধরদের নাম অন্তুর্ভুক্ত করার জন্য এই তালিকাটি হালনাগাদ করা হয়েছে। পাশপাশি, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে যারা ভারতে বসবাস করছেন তাঁদের নামও এই তালিকায় অন্তুর্ভুক্ত করার কথা রয়েছে।

এই তালিকার উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে যারা ভারতে পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে বসবাস করছেন তাঁদেরকে চিহ্নিত ও বহিষ্কার করা।

এই নাগরিকপঞ্জিটি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে ২০১৩ সাল থেকে হালনাগাদ করা শুরু হয়। এক কোটি ৯০ লাখ মানুষের নামসহ এর প্রথম আংশিক খসড়াটি প্রকাশিত হয় গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর। সোমবার প্রকাশিত হলো সম্পূর্ণ খসড়া।

তবে এনআরসি কর্তৃপক্ষের মতে, এতে যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি তারা আপত্তি বা আবার আবেদন করার সুযোগ পাবেন।

তালিকায় যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি তাঁদের বিষয়ে এখনই কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে না বলে জানিয়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। তালিকাটি সম্পূর্ণ ‘নিরপেক্ষভাবে’ তৈরি করা হয়েছে এবং যাদের নাম বাদ পড়েছে তাঁদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই বলে তিনি ভারতের জাতীয় সংসদে জানান।

এদিকে তালিকায় যাদের নাম ওঠেনি তাঁরা ৩০ আগস্ট থেকে ২৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্দিষ্ট তথ্য ও প্রমাণসহ আবেদন করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেল শৈলেশ। তবে চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি কবে নাগাদ প্রকাশিত হতে পারে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা দেননি তিনি।

ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুবাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ২০১৬ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আসামের এনআরসি হালনাগাদ করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল।

নাগরিকপঞ্জিতে ৪০ লাখ মানুষের নাম না ওঠায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও অশান্তির আশঙ্কায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসাম জুড়ে নিরাপত্তার জন্য আধাসামরিক বাহিনী মোতামেয়ন করা হয়েছে।

ভারত ও বাংলাদেশের ৪ হাজার ৯৬ কিলোটিমার সীমান্তের মধ্যে প্রায় ২৬৫ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে আসাম রাজ্যের সাথে। আসামের শতকরা ৩৪ ভাগই মুসিলম, যা কাশ্মীরের পর ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে শতকরা হারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এনআরসি থেকে বাদ পড়াদের বেশিরভাগই বাঙালি মুসলিম।

সরকারের পক্ষ থেকে এর আগে স্বীকার করা হয়েছে যে, আসামে বসবাসকারী অনেক দরিদ্র মানুষ, যারা বৈধ কাগজপত্র দেখাতে সক্ষম নন, তাঁরা এনআরসির কারণে হুমকিতে পড়ে যেতে পারেন।

এক প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের সচিবালয় নবান্নে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমরা খুবই উদ্বিগ্ন, কারণ মানুষকে নিজের দেশে উদ্বাস্তু বানানো হচ্ছে। এটি বাঙালি ও বিহারিদের আসাম থেকে বিতাড়নের পরিকল্পনার অংশ।”

তিনি বলেন, “চল্লিশ লক্ষ বাঙালিকে অভারতীয় ঘোষণা করা হয়েছে। এই সিন্ধান্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ ও বাংলা (পশ্চিমবঙ্গ)।”

“এদেরকে যদি তারা বাংলাদেশে জোর করে পাঠাতে চায় এবং বাংলাদেশ তাঁদের গ্রহণ করতে অস্বীকার করে তবে কী ঘটতে পারে? সংসদের অবশ্যই উচিত এইসব মানুষকে আইনগত সুরক্ষা দেওয়া,” বলেন মমতা।

তবে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রুহুল সিনহা মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের সাথে দ্বিমত করেন।

তিনি বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অযথাই জল ঘোলা করছেন। আসাম সরকার এই দেশের বৈধ নাগরিকদের উদ্দেশ্য করে কিছু করছে না। বরং অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে।”

এদিকে নিখিল আসাম ছাত্র সংস্থা এই নাগরিকপঞ্জিকে স্বাগত জানিয়েছে।

“আসামের জনগণের ৩৮ বছরের সংগ্রামের ফল এটি। আমরা সন্তুষ্ট, তবে আসামকে অবৈধ অভিবাসী থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে এটি প্রথম পদক্ষেপ মাত্র,” বেনারকে বলেন সংগঠনটির উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য।

অনিয়মের অভিযোগ বিরোধীদের

ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস এই নাগরিকপঞ্জিতে অনেক অনিয়ম থাকার অভিযোগ করেছে।

“সংখ্যা হিসেবে চল্লিশ লাখ মানুষের বাদ পড়া খুবই বিশাল এবং বিস্ময়কর। আমরা বিষয়টি সরকার ও সংসদে উত্থাপন করব। এর পেছনে বিজেপির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে,” বেনারকে বলেন আসামের কংগ্রেস নেতা রিপন বরা।

তৃণমূল কংগ্রেসও এর জন্য ক্ষমতাসীন বিজেপিকে অভিযুক্ত করেছে। তৃণমূলের নেতা এসএস রায় বেনারকে বলেন, “সরকার উদ্দেশ্যমূলকভাবে চল্লিশ লক্ষ ধর্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘুদের এনআরসি থেকে বাদ দিয়েছে।”

“আসামের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অবশ্যই সংসদে এর একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে,” বলেন তিনি।

এদিকে এনআরসি বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে এখনো কিছু জানানো হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

তিনি বেনারকে বলেন, “আমাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে এখনো কিছু জানানো হয়নি। সেখানে (আসামে) অবৈধ বাঙালিদের চিহ্নিত করার বিষয়ে একটা বিতর্ক শুনেছি। আমাদের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আমরা আমাদের প্রতিক্রিয়া জানাব।”

প্রসঙ্গত বাংলাদেশ বরাবরই ভারতীয় বাঙালিদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নত করার ভারতীয় চেষ্টার বিরোধীতা করে আসছে। পাশাপাশি, অতীতে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে চলে যাওয়া কারো বাংলাদেশি নাগরিকত্বও স্বীকার করে না বাংলাদেশ।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কলকাতা থেকে পরিতোষ পাল ও ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।