আসামে নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থতায় আত্মহত্যা, উদ্বিগ্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো

ঝুমুর দেব
2018.11.28
গৌহাটি, ভারত
181127-IN-Assam-1000.jpg আসামের গৌহাটিতে নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়া মানুষেরা পুনর্বিবেচনার জন্য এনআরসি সহায়তা কেন্দ্রে আবেদন করছেন। ১৩ আগস্ট ২০১৮।
[এপি]

নিজ জন্মভূমিতেই ‘বিদেশি’ আখ্যা পাওয়ার অপমানে গত মাসে আত্মহত্যা করেন আইনজীবী নিরোদ বরণ দাশ। ভারতের আসামে নাগরিকপঞ্জি প্রকাশ হওয়ার পর সেখানে নিজের নাম না থাকায় প্রতিবেশীরা তাঁকে বিদেশি হিসেবে খোঁটা দিতে থাকে। সেই গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের তিন মাসের মাথায়ই নিরোদ বরণ বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।

নিজের বাবার এই ঘটনা বর্ণনা করার সময় আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসছিল মেয়ে নিরূপমা দাশের কণ্ঠ।

ভারতের আসাম রাজ্যের ছোট শহর খারুপেটিয়া থেকে ফোনে নিরুপমা দাশ বেনারকে বলেন, “আমার বাবা একজন পরিতৃপ্ত মানুষ ছিলেন, কিন্তু তিনি গভীর বিষন্নতায় পড়ে যান।”

“তাঁকে একজন বিদেশি ঘোষণা করায় তিনি অপমানিত বোধ করছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজেকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন।”

একটি মানবাধিকার সংগঠনের মতে, আসামে নিজেদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণের চেষ্টার সময় বিভিন্ন রকমের মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করার কারণে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৩২ জন আত্মহত্যা করেছেন।

১৯৫১ সালের পর এ বছরের প্রথম দিকে আসাম তাদের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) হালনাগাদের কার্যক্রম শুরু করে। বিতর্কিত এই পদক্ষেপে রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষ ভুক্তভোগীতে পরিণত হন।

আসাম ভিত্তিক এনজিও বরাক মানবাধিকার সুরক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান প্রসেনজিত বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এনআরসির খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পর অন্তত ৩২ জন আত্মহত্যা করেছেন।”

বেনারনিউজ অন্য কোনো সূত্র থেকে আত্মহত্যার এই পরিসংখ্যান নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে বেসরকারি সংস্থা সিটিজেনস ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিসের রাজ্য সমন্বয়কারী জমশের আলী চলতি মাসে ফার্স্টপোস্ট.কমকে বলেন, তাঁর সংস্থা গত বছর এনআরসির সাথে সম্পৃক্ত ৩০টি আত্মহত্যার ঘটনা নথিবদ্ধ করেছে।

পর্যবেক্ষকদের মতে, আত্মহত্যার সঠিক সংখ্যা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হলো, এ ধরনের সংবাদ প্রচারে গণমাধ্যমের অনীহা। কারণ, সাংবাদিকরা প্রায়ই এ ধরনের ঘটনায় খবরের উপযোগিতার চেয়ে ঘটনায় জড়িত ব্যক্তির পরিবারের গোপনীয়তাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।

নিরোদ বরণ দাশের আত্মহত্যার বিষয়টি শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। নিরূপমা দাশ বেনারকে বলেন, এনআরসির চূড়ান্ত খসড়াতে নাম খুঁজে না পাওয়ায় তাঁর বাবা আত্মহত্যা করেছেন।

তিনি বলেন, “চূড়ান্ত খসড়া তালিকায় যাদের নাম নেই, তাদের মধ্যে ভয় সৃষ্টির জন্য এনআরসি নামে দুষ্ট চক্রগুলো একটি বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করেছে।”

হাজারো মানুষের নাম বাদ

নিরূপমার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নিরোদ বরণ ১৯৪৬ সালে গুয়াহাটির ১৭৫ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে তেজপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

নিরূপমা জানান, তিনি তাঁর নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য নথি দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনো কর্মকর্তা তাঁকে সাহায্য করেননি।

৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত এনআরসির আংশিক খসড়ায় নিরোদ বরণের নামসহ ১ লক্ষ ১৫ হাজার মানুষ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তবে সেই তালিকায় তাঁর পরিবার সদস্যদের নাম ছিল না।

কিন্তু ৩০ জুলাই সরকার এনআরসি’র চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশ করার পর দেখা যায়, এতে নিরোদ বরণের নাম নেই। যদিও সেই তালিকায় আবার তাঁর পরিবারের বাকি সদস্যদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ভারত সরকার মনে করে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর সীমান্ত অতিক্রম করে আসামে আসা হাজার হাজার মানুষের বাংলাদেশে ফেরত যাওয়া উচিত। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের অভিমত, তাঁরা ভারতীয়।

স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, এনআরসি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে রাজ্যের বিভিন্ন অংশে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।

“দ্বিতীয় আত্মহত্যাকারী ছিলেন দাররাং জেলার এক বাঙালি হিন্দু। তার আগে একজন স্কুল শিক্ষক আত্মহত্যা করেছিলেন,” অনলাইন সংবাদপত্র দ্যা ওয়্যারকে জানান খারুপেটিয়া শহর কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান গণেশ ঘোষ।

তিনি বলেন, “দাশের মৃত্যু হতাশা তৈরি করেছে।”

“এই শহরে জনসংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার, যার মধ্যে ৮ হাজার জনের নাম এনআরসিতে নেই।”

দাররাং জেলার ডেপুটি কমিশনার অশোক বর্মন স্থানীয় টিভি চ্যানেলকে বলেন, “দাশের আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানের জন্য তদন্ত শুরু করা হয়েছে।”

আত্মহত্যাকারীরা কোন ধর্মের অনুসারী তাৎক্ষণিকভাবে কর্তৃপক্ষ তা বলতে পারেনি। তবে ফার্স্টপোস্ট ডটকম’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর যারা আত্মহত্যা করেছেন, তাঁদের মধ্যে চারজন মুসলিম এবং ১২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী।

এদিকে গত সপ্তাহে, আসামের সোনিতপুর জেলার ৬৫ বছর বয়সী এক বাঙালি মুসলমান মাননাস আলী আত্মহত্যা করেছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় সংবাদপত্র।

ওই রিপোর্টে আলীর প্রতিবেশীদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় যে, এনআরসির চূড়ান্ত খসড়ায় তাঁর ছেলে ও দুই নাতির নাম না আসার ঘটনা তাঁকে খুব বিষণ্ণ করে তুলেছিল।
পুনর্বিবেচনা প্রক্রিয়ায় ধীর গতি

এদিকে, আসামে নাগরিকপঞ্জিতে নাম তোলার আবেদন পুনর্বিবেচনা প্রক্রিয়া চলছে খুব ধীরে। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট এনআরসিতে নাম অন্তর্ভুক্ত করার দাবি ও আপত্তি দাখিলের সময়সীমা ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করেছে।

প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গাগৈয়ের নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চ পাঁচটি নথি ব্যবহার করে নাগরিকত্ব প্রমাণের বিধান দেয়।

এই পাঁচটি নথি হলো- ১৯৫১ সালের এনআরসি, ১৯৬৬ সালের ভোটার তালিকা, ১৯৭১ এর ভোটার তালিকা, ১৯৭১ পর্যন্ত শরণার্থী নিবন্ধন সার্টিফিকেট এবং ১৯৭১ সাল পর্যন্ত রেশন কার্ড।

এনআরসির হালনাগাদ করার কর্মসূচিটি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। ভারত সরকারের মতে, এনআরসির মূল লক্ষ্য ভারতে বসবাসকারী আনুমানিক ২০ লাখ অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী শনাক্তকরণ ও বহিষ্কার।
নাগরিকত্ব দাবি ও আপত্তির আবেদন গ্রহণের জন্য সারা দেশে প্রায় ২ হাজার ৭০০ এনআরসি সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক এনআরসি কর্মকর্তা জানান, মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ নাগরিকত্ব পুনর্বিবেচনা করার জন্য আবেদন করেছেন।

প্রসঙ্গত এই বছরের ৩১ জুলাই এনআরসির চূড়ান্ত খসড়া তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর দেখা যায় যে, প্রায় চল্লিশ লক্ষ মানুষ তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্ব হারিয়েছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।