ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে মন্ত্রিসভার অনুমোদন

পরিতোষ পাল
2019.12.04
কলকাতা
191204_CAB_1000.jpg আসামের রাজধানী গৌহাটিতে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের বিক্ষোভ। ৪ নভেম্বর ২০১৯।
[এএফপি]

প্রতিবেশি দেশগুলি থেকে শরণার্থী হয়ে আসা অ-মুসলিম জন গোষ্ঠীর মানুষকে নাগরিকত্ব দিতে নাগরিকত্ব বিলে সংশোধনী আনা হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা বুধবার বিতর্কিত এই নাগরিক সংশোধনী বিলে অনুমোদন দেয়। আগামী সপ্তাহে বিলটি পাশ করানোর জন্য সংসদে পেশ করা হবে।

এদিন মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও সরকারের মুখপাত্র প্রকাশ জাভড়েকার সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পৌরোহিত্যে মন্ত্রিসভা বেশ কয়েকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এগুলির অন্যতম হলো নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে সম্মতি দেওয়া।"

তিনি জানান, “সংসদে পেশ করার পর এই বিলটি নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা হবে।”

এই বিলে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে চলে আসা হিন্দু, পার্সি, শিখ, খ্রিস্টান শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে।

১৯৫৫ সালের ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন করেই এই নতুন বিল আনা হয়েছে।

গত লোকসভায় বিলটি পাশ হলেও রাজ্যসভায় সরকার পক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় বিলটি পেশই করা হয়নি। ফলে লোকসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিলটি খারিজ হয়ে যায়।

বিল নিয়ে বিতর্ক

বিলটি নিয়ে গত প্রায় এক বছর ধরেই বিতর্ক চলছে। ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ধর্মের ভিত্তিতে শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেবার এই চেষ্টাকে সংবিধানের বিরোধী বলে আখ্যা দেয়।

এদিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পরে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ ডেরেক ওব্রায়েন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের সমালোচনা করে এক বিবৃতিতে বলেন, “সংবাদ মাধ্যমে যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে সস্তা এবং সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের কথা ভেবে বিজেপি এ বিল আনছে।”

“তৃণমূল কংগ্রেস আগামী সপ্তাহে সংসদে দলের অবস্থান এবং এ বিলের প্রেক্ষিত নিয়ে মতামত জানাবে,” বলে জানান তিনি।

অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমেনের প্রধান সাংসদ আসাউদ্দিন ওয়াইসি বিলের সমালোচনা করে সাংবাদিকদের বলেন, “এই বিল আনার মাধ্যমে দ্বিজাতি তত্ত্বকে তুলে ধরে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরই অপমান করা হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “ভারতীয় মুসলমান হিসেবে আমি জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করেছি। কিন্তু এখন এমন আইন করা হচ্ছে যার মাধ্যমে দুর্ভাগ্যবশত দ্বিজাতি তত্ত্বকেই মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”

তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যপক বিমল শঙ্কর নন্দ বেনারকে বলেন, এই বিলের মাধ্যমে “বিজেপি সরকার আসলে হিন্দুদের নিরাপত্তা দেবার মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডাই কার্যকর করছে। ভারত যে হিন্দুদের দেশ সেটাই তারা আরও জোরদারভাবে প্রচার করবে।”

তিনি বলেন, “আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী থেকে প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়ায় বিজেপি অস্বস্তিতে পড়েছে। কেননা, এর অধিকাংশই বাঙালি হিন্দু। আর তাই তড়িঘড়ি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ করানো হচ্ছে।”

বিতর্কিত এই বিল নিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে প্রবল অসন্তোষ তৈরি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ উত্তর-পূর্ব ভারতের সব মুখ্যমন্ত্রী ও বিভিন্ন সংগঠনের প্রায় ৬০০ প্রতিনিধির সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে বৈঠক করেছেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

এই বৈঠকের পরেই বিলটিতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে বলা হয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির স্বশাসিত ও বিশেষ সুরক্ষাপ্রাপ্ত এলাকাগুলোকে এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।

বিলের পরিধি থেকে বাদ রাখা হয়েছে অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামের ইনার লাইন পারমিট এলাকাসমূহকেও। বর্তমানে ইনার লাইন পারমিট-ভুক্ত অঞ্চলে যেতে হলে ভারতের অন্য এলাকার নাগরিকদেরও বিশেষ অনুমতি নিতে হয়।

সরকারি সূত্রে বলা হয়েছে, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় বা মিজোরামের আদিবাসী-অধ্যুষিত যে সব এলাকা সংবিধানের ষষ্ঠ শিডিউল অনুসারে স্বশাসনের অধিকার ভোগ করে, সেখানেও এই নতুন বিল প্রযোগ হবে না।

উত্তর-পূর্ব ভারতের বাঙালিরা বিপন্ন

ত্রিপুরা ও আসামের সমতল অঞ্চল বাদে বাকি সমগ্র অঞ্চলে বাঙালিরা এই নাগরিকত্ব সংশোধনীর ফলে বিপন্ন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন বিভিন্ন সামাজিক সংঘঠনের নেতারা।

আসামের নাগরিক অধিকার রক্ষা কমিটির সচিব প্রধান সাধন পুরকায়স্থ বেনারকে বলেন, “যে আকারে বিলটি আনা হয়েছে তাতে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিশাল অঞ্চলের বাঙালি নাগরিকত্ব পাওয়ার আবেদন করার সুযোগ পাবেন না। তাদের কোনও অধিকারই থাকবে না।”

তিনি বলেন, “আইন করে বাঙালির নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার এই প্রচেষ্টা মানবাধিকার লঙ্খনের সামিল। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানেরই অবমাননা করা হচ্ছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।