মামলার মুখে ভারতের নাগরিকত্ব আইন, আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন রাজ্যে

পরিতোষ পাল
2019.12.13
কলকাতা
191213_WB_Protest_620.jpg নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার নলহাটিতে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন প্রতিবাদকারীরা। ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

আইনে পরিণত হওয়া ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের (ক্যাব) প্রতিবাদে আসাম ও মেঘালয় ছাড়াও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি ও তামিল নাডুতে। পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গণআন্দোলনের ডাক দিয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভ। কোথাও রেললাইন, কোথাও জাতীয় সড়ক অবরোধ করে আগুন জ্বালিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। বন্ধ হয়ে পড়ে রেল পরিসেবা।

রেলওয়ে পুলিশের এডিজি অধীর শর্মা বেনারকে বলেন, “উলুবেড়িয়া ও বেলডাঙ্গাতে লাইনের উপর টায়ার জ্বালানো হয়। এ ছাড়া কেবিন লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়ার ঘটনা ঘটে।”

তবে কেউ আহত হবার কথা তিনি অস্বীকার করেন।

হাওড়ার উলুবেড়িয়া, মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা, বহরমপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় এদিন ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। কলকাতার মুসলমান অধ্যুষিত পার্ক সার্কাস অঞ্চলেও মানুষ বিতর্কিত ওই বিলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেন।

দিল্লিতে জামিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ক্যাবের প্রতিবাদে ক্যাম্পাস থেকে মিছিল করে সংসদ অভিমুখে রওনা হলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সরাতে কাঁদানে গ্যাসের সেল নিক্ষেপ করে। বেশ কয়েকজন ছাত্রকে আটক করা হয়।

উত্তর প্রদেশের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। শহরের ইন্টারনেট পরিসেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তামিলনাড়ুতেও ডিএমকের যুব ছাত্ররা আইনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন।

এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘর মহাসচিবের মুখপাত্র শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, “আমরা ক্যাবের সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে তা বিশ্লেষণ করছি।”

ক্যাব প্রয়োগে বাধা দেবে রাজ্য

নতুন নাগরিকত্ব আইনটি কোনোভাবেই প্রয়োগ করতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন পাঁচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক দিন ধরেই কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলে এসেছেন, তিনি জীবন থাকতে রাজ্যে নাগরিকত্ব আইন প্রয়োগ করতে দেবেন না।

বৃহস্পতিবার কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পীনারাই বিজয়ন জানিয়েছেন, তাঁর রাজ্যে অসাংবিধানিক এই নাগরিকত্ব আইন প্রয়োগ করতে দেবেন না।

তাঁর এই ঘোষণাকে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দার সিং ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমর্থন জানান। শুক্রবার মধ্য প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথ এবং ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী ভুপেশ বাঘেলাও একই ঘোষণা দেন।

এদিনই নতুন আইন বন্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে বিশিষ্ট ভোট কুশলি এবং জনতা দল (ইউ)-র সহসভাপতি টুইটারে ভারতের আত্মাকে বাঁচানোর লক্ষ্যে অবিজেপি রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের একজোট হয়ে সিদ্ধান্ত নেবার আবেদন জানান।

মেঘালয়ের চেকপোস্ট বন্ধ, ছাত্রদের অনশন

শুক্রবার সকাল থেকে মেঘালয়ের ডাউকি-তামাবিল ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে কোনও বিদেশিকে প্রবেশ করতে দেয়নি ভারত। সরকারিভাবে এ ব্যাপারে কোনো ঘোষণা দেওয়া না হলেও নিরাপত্তার কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে ভারত ও বাংলাদেশের একাধিক গণমাধ্যম শুক্রবার খবর প্রকাশ করেছে।

টানা তিনদিন ধরে আসামে চলা বিক্ষোভের পর শুক্রবার ক্যাব প্রত্যাহারের দাবিতে অল আসাম ছাত্র ইউনিয়নের (আসু) ডাকে আসাম ইঞ্জিনিয়ারিং ইস্টিটিউটের মাঠে ১০ ঘন্টার অনশন পালন করা হয়। এদিনও আসুর নেতারা ঘোষণা দেন, আসামের জনজাতিদের স্বার্থে এই লড়াই চলবে। অনশনে সাধারণ মানুষ ছাড়াও লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা যোগ দেন।

আসাম ও মেঘালয়ে কারফিউ কয়েক ঘন্টার জন্য শিথিল করা হলেও ইন্টারনেট ও এসএমএস পরিষেবা এদিনও নিষিদ্ধ রাখা হয়।

“গুয়াহাটি, ডিব্রুগড় ও শিলংয়ের মতো শহরের এলাকাকে যুদ্ধক্ষেত্রের পরবর্তী অবস্থা বলে মনে হয়েছে,” বেনারকে টেলিফোনে জানান স্থানীয় শিক্ষক অভিরুপ দাস।

“গাড়ির কাচ, আগুনে পোড়া ব্যারিকেড ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে। অনেক জায়গায় দোকান পাট ভাংচুরের চিহ্ন রয়েছে,” জানান তিনি।

এদিকে ক্যাব বিরোধী আন্দোলনের জেরে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর মেঘালয় সফর বাতিল করা হয়। রোববার তাঁর শিলংয়ে উত্তর-পুর্ব পুলিশ একাডেমির অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল।

জাপান প্রধানমন্ত্রীর সফর বাতিল

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরে ভারত সফর বাতিল করেছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। ১৫-১৭ ডিসেম্বর গুয়াহাটিতে ভারত-জাপান বার্ষিক সম্মেলনে আবের যোগ দেবার কথা ছিল। সফর বাতিল নিশ্চিত করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র টুইটারে জানান, দুপক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে শিনজো আবের সফর স্থগিত করা হয়েছে।

কংগ্রেসের প্রবীন নেতা আনন্দ শর্মা শুক্রবার রাজ্যসভায় উত্তর-পূর্ব ভারতের উদ্বেগজনক অবস্থা নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার আহবান জানান।

ক্যাবের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই

বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিবাদের মধ্যে শুক্রবার নতুন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদন জমা দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মহুয়া মৈত্র এবং কংগ্রেসের জয়রাম রমেশ।

সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া জানায়, মহুয়ার আবেদনটি দ্রুত শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চে নথিভুক্ত হয়েছে।

জয়রাম রমেশ তাঁর আবেদনে বলেছেন, নাগরিকত্ব বিলের সংশোধনীটি সংবিধানে বর্ণিত মূল মৌলিক অধিকারের উপর আক্রমণ। নতুন এই সংশোধনী সংবিধানের ১৪ ও ২১ অনুচ্ছেদকে লঙ্ঘন করেছে।

গত বৃহস্পতিবার ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগের পক্ষ থেকেও নতুন আইনকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জমা দেওয়া হয়।

সংসদের দুই কক্ষে পাশ হওয়ার পর অমুসলিম শরণার্থীদের প্রাধান্য দিয়ে আনা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে বৃহস্পতিবার রাতে স্বাক্ষর করেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। এ রাতেই গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আইনটি কার্যকর হওয়ার কথা সরকারিভাবে জানানো হয়।

নতুন এই আইনে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে প্রতিবেশি তিন দেশ; বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা শরণার্থীরা ৫ বছর টানা ভারতে বসবাস করলেই তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তবে এই আইনে মুসলিমদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়নি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।