নাগরিকত্ব আইন: জুমার নামাজের পর দিল্লি ও ঢাকায় বিক্ষোভ

পরিতোষ পাল
2019.12.20
কলকাতা
191220_WB_story-Bangla_1000.jpg ভারতের বিতর্কিত নতুন নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে ‘মুসলিম বিতাড়নের চক্রান্তের’ প্রতিবাদে ঢাকার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সামনে কয়েকটি ইসলামী দলের বিক্ষোভ সমাবেশ। ২১ ডিসেম্বর ২০১৯।
[প্রাপ্তি রহমান/বেনারনিউজ]

বিতর্কিত নতুন নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে দিল্লি ও ঢাকার সবচেয়ে বড় দুটি মসজিদে জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন মুসল্লিরা। ভারতের দশটি রাজ্যের অন্তত ২০টি শহরে শুক্রবার সাধারণ মানুষ, ছাত্র-যুব ও রাজনৈতিক দলের কর্মীরা বিক্ষোভ করেছেন।

শুক্রবার উত্তর প্রদেশে অন্তত পাঁচ ব্যক্তির মৃত্যুর খবর সরকারিভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে, বেসরকারি বিভিন্ন সূত্র বলছে, মৃতের সংখ্যা ছয়জন।

এই পরস্থিতিতে শুক্রবার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ভারত সরকারের কড়া সমালোচনা করেছেন।

সব মিলিয়ে আইনটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে গত এক সপ্তাহের আন্দোলনে মারা গেছেন ১৪ ভারতীয় নাগরিক। এর আগে আসামে পাঁচজন, উত্তর প্রদেশের লক্ষৌতে একজন এবং কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালোরে দুজন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়।

শুক্রবার রাতে উত্তর প্রদেশের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব অবিনাশ অবস্থি সাংবাদিকদের জানান, রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় শুক্রবার নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক বিক্ষোভের সময় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। বেসরকারি হিসেবে অবশ্য বলা হয়, বিজনৌরে দু’জন এবং সম্বল, ফিরোজাবাদ, মীরাটে ও কানপুরে একজন করে বিক্ষোভকারী নিহত হওয়ার কথা।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার দেশটির বিভিন্ন শহরে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ অনেক জায়গায় লাঠি, কাঁদানে গ্যাস ও গুলি চালায়।

উত্তর প্রদেশের ১৩টি জেলায় জুমার নামাজের পর থেকে বিক্ষোভ তীব্র হয়ে ওঠে। এই পরস্থিতিতে কংগ্রেসের কার্যকরী সভাপতি সোনিয়া গান্ধী টুইটার বার্তায় বলেন, সরকারি নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং উদ্বেগ জানানোর গণতান্ত্রিক অধিকার এ দেশের মানুষের রয়েছে। কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার মানুষের প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে বল প্রয়োগ ও দমনরে পথ বেছে নিয়েছে।

প্রতিবাদে বিশিষ্টজনেরাও

কলকাতা, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু ও চেন্নাইয়ে অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা থেকে শুরু করে ইতিহাসবিদরাও নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন।

প্রখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক মুজতবা হুসেন পদ্মশ্রী সম্মাননা ফিরিয়ে দেবার ঘোষণা দিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘বর্তমানে দেশের যা পরিস্থিতি, তাতে ওই পুরস্কার বাড়িতে রাখতে চাই না।’’

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার বেনারকে বলেন, “দেশের মানুষের মতকে অগ্রাহ্য করে শুধু সংখ্যার জোরে যে আইনটি পাশ করানো হয়েছে, তা মূলগতভাবে অবৈধ।”

তিনি বলেন, “দেশ জুড়ে এই অবৈধ আইনের বিরুদ্ধে মানুষ ধর্ম, বর্ণ নির্বেশেষে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। শাসকদের এই প্রতিবাদ দেখে শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং আইনটি প্রত্যাহার করা উচিত।”

ভারত সরকারের ব্যাখ্যা

নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করার জন্য নীতিমালা এখনও তৈরি করা হয়নি। এজন্য ছাত্রসহ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মতামত চাওয়া হয়েছে। সংবাদমাধ্যমকে এ কথা জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক আধিকারিক।

সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া জানায়, ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে কোনও ব্যক্তি বা তাঁর অভিভাবক জন্মগ্রহণ করলে তিনি আইন অনুযায়ী ভারতের বৈধ নাগরিক বলে বিবেচিত হবেন। তাই নতুন নাগরিকত্ব আইন বা দেশ জুড়ে চালু হতে যাওয়া সম্ভাব্য নাগরিকপঞ্জি নিয়ে কারও উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রযোজন নেই।

আসামের ক্ষেত্রে অবশ্য ভারতের নাগরিক হওয়ার ভিত্তিবর্ষ ১৯৭১ সাল।

নাগরিকত্ব আইন নিয়ে চলমান বিক্ষোভ এবং সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরনের তথ্য প্রচারিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।

নতুন নাগরিকত্ব আইনে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে প্রতিবেশী তিন দেশ; বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা অমুসলিম শরণার্থীরা পাঁচ বছর টানা ভারতে বসবাস করলেই তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তবে এই আইনে মুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেবার কথা বলা হয়নি।

গত ১০ ডিসেম্বর নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় পাশ হয়। পরে ১১ ডিসেম্বর বিলটি সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভাতেও পাশ হয়। এরপর বিলটিতে ১২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি সই করলে সেটি আইনে পরিণত হয়।

দিল্লি জামে মসজিদে বিক্ষোভ

ভারতের রাজধানী দিল্লি শুক্রবার বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষ সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে বিক্ষোভে যোগ দেন। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষও হয় কয়েকটি এলাকায়। কয়েকটি এলাকায় পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে।

সবচেয়ে বড় জমায়েত হয় দিল্লি জামে মসজিদে। জুমার নামাজের পর পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে সেখান থেকে বিশাল মিছিল বের করা হয়।

মহিলা কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বাসভবনের বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। পুলিশ কংগ্রেস নেত্রী শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়সহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।

সতর্কতা হিসেবে উত্তর-পূর্ব দিল্লির ১২টি থানা এলাকায় মিছিল-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। আইন-শৃঙ্খলার দিকে নজর রাখতে ড্রোন নামানো হয়।

এ ছাড়া বিক্ষোভকারীদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে দিল্লি মেট্রোর ১৩টি স্টেশন বন্ধ রাখা হয়। মেট্রো করপোরেশনের টুইটারে শুক্রবার একথা জানানো হয়।

কর্ণাটকে বৃহস্পতিবার দু’জনের মৃত্যুর জের ধরে ম্যাঙ্গালোর শহরে জারি হয়েছে কারফিউ। শনিবার পর্যন্ত চার জনের বেশি জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পুরো শহরে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয় ৪৮ ঘণ্টার জন্য।

ম্যাঙ্গালোরের পুলিশ কমিশনার পি এস হর্ষ সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘সারা শহরে কারফিউয়ের সময় বাড়িয়ে ২২ ডিসেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত করা হয়েছে।’’

বেঙ্গালুরুর পুলিশ কমিশনার ভাস্কর রাও সাংবাদিকদের জানান, ‘শুক্রবার পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি থাকবে।”

পরিস্থিতি সামাল দিতে বৃহস্প​তিবার উত্তর প্রদেশের সর্বত্র ১৪৪ ধারা জারি হয়। বেশ কিছু এলাকায় শুক্রবার রাত ১০টা পর্যন্ত ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়।

সেখানে মোবাইল ফোনে এসএমএস আদান-প্রদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন সাধারণ মানুষ। এনআরসি এবং সিএএ-এর বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের অধীনে গণভোটের ডাক দিলেও শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাগরিকত্ব আইন বাতিল করার আবেদন জানান।

এদিকে বিহার রাজ্যে এনআরসি চালু না করতে দেবার ঘোষণা দিয়েছেন সংযুক্ত জনতা দল (জেডিইউ)-বিজেপি জোট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। সংবাদসংস্থা এএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শুক্রবার নীতিশ কুমার বলেন, বিহারে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) কার্যকর করা হবে না।

এর আগে পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, কেরালা, দিল্লি ও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীরা তাঁদের রাজ্যে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি এবং নতুন নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করা হবে না বলে ঘোষণা দেন।

নাগরিকত্ব আইনের সমালোচনায় মাহাথির

শুক্রবার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ কুয়ালালামপুরে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আমাদের দেশে যেসব ভারতীয় এসেছে, চীনারা… তাদের সকলকে গ্রহণ করেছি। এমনকি যোগ্যতামান উত্তীর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও সকলকে নাগরিকত্ব দিয়েছি এবং তারা সরকারেও রয়েছে।”

“কিন্তু আমি দুঃখিত যে, ভারত নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে দাবি করা সত্ত্বেও কিছু মুসলিমকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করতে ব্যবস্থা নিচ্ছে। অথচ আমরা যদি এখানে তা করতাম তাহলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতো, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতো এবং এর ফলে আমরা সকলে ভুগতাম,” বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী মাহাথির আরও বলেন, “ইতিমধ্যে এই আইনের কারণে মানুষ মারা যাচ্ছে। প্রায় ৭০ বছর ধরে কোনও সমস্যা ছাড়াই নাগরিকেরা যখন একসঙ্গে বসবাস করছে সেখানে এটা করার কী দরকার ছিল?”

ঢাকায় ইসলামী দলগুলোর বিক্ষোভ

সমমনা ইসলামী দলগুলোর আয়োজনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা অভিযোগ করেছেন, এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের নামে ভারত থেকে মুসলিম বিতাড়নের চক্রান্ত চলছে।

শুক্রবার জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেটে ওই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের বলেন, “ভারতের এনআরসি-সিএএ বাংলাদেশের জন্যে বড় সমস্যা। এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারকে কথা বলতে হবে, কড়া প্রতিবাদ জানাতে হবে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এনআরসি-সিএএ-কে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করায় কড়া সমালোচনা করে আবদুল কাদের বলেন, “এটা আর ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নেই। ইতোমধ্যেই আসামে এনআরসি’র মাধ্যমে ১৯ লক্ষ মানুষকে নাগরিকত্বহীন করা হয়েছে, যারা বাংলাভাষী ও মুসলমান। আসাম থেকে এসব মানুষদের তাড়িয়ে দিলে আমাদের দেশের কী অবস্থা হবে, তা বোঝার চেষ্টা করুন।”

তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে ইতোমধ্যেই ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সম্প্রতি কুষ্টিয়া-বোনাপোল সীমান্ত দিয়ে বহু মানুষকে বাংলাদেশে পুশব্যাক করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কুয়ালালামপুর থেকে মুজলিজা মুস্তফা ও ঢাকা থেকে প্রাপ্তি রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।